নিউজ ডেক্স : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম জলপাইতলী সীমান্ত পয়েন্টের শূন্য রেখায় পলিথিনের তাবু টাঙিয়ে আতঙ্কে ক্ষণ গুনছেন সেখানে অবস্থান করা অসংখ্য রোহিঙ্গা। সবার চোখে-মুখে আরাকানে চলমান অরাজকতার আতঙ্ক।
তবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মোহছেনা বেগমের (২০) অন্য অভিব্যক্তি। সপ্তাহ খানেক আগে জন্ম নেয়া কন্যা শিশুটিকে বাঁচানো যাবে কি না এনিয়েই বিচলিত সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের মংডুর ঢেকিবনিয়ার রুহুল আমিনের স্ত্রী মোহছেনা।
তিনি বলেন, মাত্র এক সপ্তাহ আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছে তার কন্যা শিশুটি। সব কিছুই ঠিক-ঠাক চলছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে অকস্মিক গোলাগুলি ও দূরের কিছু গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার তথ্য আসে। এতেই চোখে ভাসে গত বছরের অক্টোবরের সেই নির্যাতনের চিত্র। তাই অসুস্থ শরীরে শিশু সন্তান কোলে অন্যদের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছেন।
মোহছেনা বলেন, অমানবিক এক পরিস্থিতি পার করছি। পেছনে গুলি ও আগুনের লেলিহান শিখা, সামনে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রতিরোধ। অসহায় অবস্থায় খোলা আকাশেই পলিথিন টাঙিয়ে বসে অভুক্ত রাত-দিন পার করছি। নিজে মরি-বাঁচি এতে কোনো অসুবিধা নেই। এখন বড় দুচিন্তা শিশুটিকে বাঁচাতে পারব তো?
শুধু মোহছেনা নয় একই পরিস্থিতিতে এলাকা ছেড়েছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ রশিদ আহমদও। তিনি জানান, আরকান রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া গ্রামে ৪ ছেলে ৬ মেয়ে নিয়ে তাদের পরিবার ছিল। শুক্রবার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। তিনি নিশ্চিত ধরে নিয়ে যাওয়া ছেলেরা আর জীবিত ফিরবে না। তাই বাকিদের নিয়ে প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশের সীমানায় পালিয়ে এসেছেন তারা। মোহছেনা ও রশিদ আহমদের মতো কয়েক হাজার নারী-পুরুষ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে।
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার অজুহাতে নিরাপত্তা বাহিনী নিপীড়ন চালাচ্ছে। সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পুলিশ পোস্টে হামলা এবং একটি সেনাঘাঁটিতে বিদ্রোহীরা ঢুকে পড়ার কথা বলে সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। এরপর শুক্রবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে গত বছরের মতো নির্বিচারে গুলি করে হত্যা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া শুরু করে।
এতে ভয়ে ঢেকেবুনিয়া উত্তর পাড়া থেকে পালিয়ে আসা জাকারিয়ার স্ত্রী হাফসা বলেন, গত কদিন ধরে চলমান নির্যাতন সইতে না পেরে এদেশে আশ্রয় নিয়েছি। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফেরৎ যাব।
একই গ্রামের খুশি আলমের ছেলে মোস্তাক আহমদ (৬৫) বলেন, ঢেকেবুনিয়া উত্তরপাড়া এলাকার ২১০টি পরিবার এখানে চলে এসেছে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা চলে যাব।
ঢেকিবুনিয়া মিয়াপাড়ার বাদশামিয়া (৫০) জানান, তাদের এলাকার প্রায় ৪০ পরিবার সীমান্তে এসেছে। শনিবার তাদের পার্শবর্তী চামকাকাটা পাড়া পুড়িয়ে দেয়ার পর আতঙ্কিত হয়ে সবাই পালিয়ে এসেছেন।
ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া ফকিরাপাড়ার আবুল বশর (৬৫), আহমদুর রহমানসহ (৫০) অসংখ্য রোহিঙ্গা জানান, শনিবার দুপুর ২টার দিকে সেদেশের একটি সামরিক হেলিকপ্টার ঢেঁকিবনিয়া সেনা ও বিজিপি ক্যাম্পে আসে। বিকেল ৩টার দিকে ওই হেলিকপ্টারটি চলে যাওয়ার পর পরই সেনা, বিজিপি ও স্থানীয় রাখাইনরা যৌথভাবে সীমান্ত সংলগ্ন ঢেঁকিবনিয়া, চাককাটা, ঢেঁকিপাড়া, ফকিরাপাড়া, চাকমাকাটাসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রামে হামলা শুরু করে। এ সময় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই বেদম মারধর করেছে। এ কারণে সে সব এলাকা থেকে তারা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে বিজিবির কড়া নজরদারির মাঝেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। স্থানীয়দের মতে, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, উলুবনিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্যং, লম্ববিল, উৎছিপ্রাং, ঝিমংখালী, খারাংখালী, হ্নীলার পুলের ডেইল, রঙ্গীখালী ও চৌধুরীপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করছেন তারা। সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় যত নারী-পুরুষ দেখা যায় পরের দিন সকাল বেলা আলো ফোটার পর অত সংখ্যক আর চোখে পড়ে না। টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে নতুন আসা রোহিঙ্গারা অবস্থান নিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
তবে বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা বার বারই অস্বীকার করে আসছেন। তিনি বলেন, সীমান্তে বিজিবির কড়া নজরদারি রয়েছে। কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, আর কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চায় না সরকার। তাই কঠোরতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয়দেরও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।