ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ সহযোগীসহ আটক

রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ সহযোগীসহ আটক

Nur-Mohammed-Dacoit_Teknaf_31-08-2019

নিউজ ডেক্স : জনতার হাতে অবশেষে ধরা পড়লো টেকনাফের শালবনকেন্দ্রিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নূর মোহাম্মদ ওরফে নুর মোহাম্মদ ডাকাত।আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে টেকনাফের রঙ্গিখালী উলুচামরী পাহাড়ি এলাকায় সহযোগী অপর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আমান উল্লাহসহ ধরা পড়ে নূর মোহাম্মদ। পরে জনতা তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

আটক নুর মোহাম্মদ জাদিমোড়া জুম্মা পাড়া ২৭নং শিবিরে এলাকায় বসবাস করে আসছিল। তার পিতার নাম কালা মিয়া। ১৯৯১ সালের পরে নূর মোহাম্মদ মিয়ানমার হতে পালিয়ে এসে হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোড়া এলাকায় বসবাস শুরু করে। পরে এখানে বেশ কয়েকটি বিয়ে করে নিজের অবস্থান শক্তিশালী ও সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে ইয়াবা পাচার, হত্যা গুমসহ নানা অপরাধ সংগঠিত করে যাচ্ছিল।

তার অপর সহযোগী আমান উল্লাহ টেকনাফ নয়া পাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের বি ব্লকের সেড নং ৭৪৯ এর ৪নং কক্ষের বাসিন্দা। তার পিতার নাম মো. শফি প্রকাশ কালা ডাক্তার। এরা রঙ্গিখালী এলাকায় অপর একটি ডাকাত গ্রুপের হাতে আগে ধরা পড়ে। তারা পুলিশে না দেয়ার শর্তে নূর মোহাম্মদ ডাকাত হতে ৩০ লাখ টাকা আদায় করে। পরে টাকা হাতিয়ে নিয়ে ডাকাত দল রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদকে সহযোগীসহ পুলিশের হাতে তুলে দেয় বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এ বিষয়ে হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘এ ধরনের বিষয়টি আমারও কানে এসেছে। তবে পরে খোজঁখবর নিতে হবে।’

গত ২২ আগস্ট রাতে স্থানীয় যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক খুন হওয়ার ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরপর এলাকাবাসী রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়। প্রধান সড়ক অবরোধ করে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল প্রতিহত করতে থাকে।

এদিকে এ ঘটনার জের ধরে ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে বন্দুকযুদ্ধে তিনজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী মারা যায় যারা যুবলীগ নেতা হত্যার আসামী। এ মামলার প্রধান আসামী হচ্ছে আটক নূর মোহাম্মদ।

যুবলীগ নেতা হত্যাকান্ডের পর আইনশৃংখলা বাহিনীও রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী দমনে তৎপর হয়ে উঠে। এতে সন্ত্রাসীরা শিবির হতে পালিয়ে পাহাড়ে অবস্থান নেয়।

এদিকে দু’জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটকের কথা স্বীকার করেছে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস। তিনি জানান, জনতার সহায়তায় তাদের আটক করা হয়।

কে সেই নুর মোহাম্মদ
গত ২২ আগস্ট ছিল নূর মোহাম্মদের মেয়ের কর্নছেদন অনুষ্ঠান। জাদিমোড়ার পাহাড়ি এলাকায় জনৈক মেহের আলীর বাগান বাড়িতে তৈরি করা হয় আয়োজন। দু’টি গরু জবাই করে কক্সবাজার হতে গানের শিল্পী এনে মহাধুমধামের সাথে দিনে রাতে চলে জমকালো আয়োজন। এতে তার শুভাকাঙ্খীরা মেয়ের জন্য উপহার হিসেবে দেয় ৪৫ লাখ নগদ টাকা ও এক কেজি স্বর্ণালংকার।

এ অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে নূর মোহাম্মদের ডান হাত বলে খ্যাত লম্বা সেলিমের সাথে নূর মোহাম্মদ গ্রুপের অপর সদস্যদের মধ্যে মদপানরত অবস্থায় গন্ডগোল বাধে। লম্বা সেলিম বিষয়টি তার ওস্তাদ নূর মোহাম্মদকে মোবাইল ফোনে বিচার দেয়। তখন নূর মোহাম্মদ ঘটনাস্থলে না থাকায় লম্বা সেলিম ওস্তাদকে এগিয়ে আনতে যাওয়ার সময় পথে টর্চলাইটের আলো ফেলা নিয়ে যুবলীগ নেতা উমর ফারুকের সাথে বাদানুবাদ হয়। এক পর্যায়ে লম্বা সেলিমের নেতৃত্বে ১৫/২০ জনের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা উমর ফারুককে ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করে।

নূর মোহাম্মদ এখানে অবস্থান করে থাকলেও ছিল কৌশলী। রোহিঙ্গা শিবির বা টেকনাফের কোথাও সে ভোটার বা নিবন্ধিত হয়নি। ফলে এখানে তার কোনো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। সে কৌশলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বাংলাদেশী হিসেবে ভোটার আইডি সংগ্রহ করেছে বলে একটি সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মিয়ানমারের মংডু এলাকা হতে ১৯৯১ সালের পরে নাফনদী পাড়ি দিয়ে কালা মিয়ার ছেলে নূর মোহাম্মদ জাদিমোড়া এলাকায় অবস্থান নেয়। গড়ে তোলে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আরসা সামরিক প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ’র ডান হাত হিসেবে পরিচিত নুর আলম অবস্থান করতেন টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে। নয়া পাড়াতে দুই স্ত্রী ও লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পে অপর স্ত্রী অবস্থান করায় নুর আলম দুই ক্যাম্পে সমান আধিপত্য রাখত।

এছাড়া আরসা প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ’র সাথে ভিডিওতে নুর আলমকে ভারি অস্ত্র হাতে ডান পাশে দেখা যাওয়ায় তাকে সবাই সমিহ করে চলতো।

এছাড়া র‌্যাব-৭ এর হাতে আটক হয়ে নয়া পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লুন্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার, পরে জামিনে মুক্ত হওয়ায় তার শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে আরসা ও রোহিঙ্গাাদের মাঝে। ২০/২৫ জনের এ প্রুপের অপর কয়েকজন উপ-প্রধান হচ্ছেন জাদিমুড়ার নুর মোহাম্মদ, মুছনী নয়াপাড়ার লম্বা সেলিম, মাষ্টার আবুল কালাম আজাদ, খাইয়ুর আমিন।

এ প্রুপটি ২০১৬ সালের ১৩ মে ভোররাতে নয়াপাড়া শালবন আনসার ব্যারাকে হামলা চালায়। খুন করে আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে। লুট করে নিয়ে যায় ২টি এসএমজি, ৫টি চায়না রাইফেল, ৪টি শর্টগান ও ৬৭০টি গুলি। পরে অবশ্য অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে র‌্যাব-৭।

এ গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে নুরুল আলম, হাসেম, হাসান, জামাল, রুবেল, মাহামুদুল হাসান ও শুক্কুর।

এ প্রুপের প্রধান নুর আলম গত জানুযারি মাসের প্রথম দিকে জেল হতে বের হয়ে পুনরায় সংগঠিত হয়ে লেদা ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে আলীখালী পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে অপকর্ম চালায়। সম্প্রতি আলোচিত সেই নুরুল আলম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এখন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড লম্বা সেলিম দায়িত্ব পালন করছে।

গত ২২ আগস্ট রাতে লম্বা সেলিমের নেতৃত্বে একদল রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসী টেকনাফের লেদা ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি উমর ফারুককে হত্যা করে। তাদের হাতে ভারী অস্ত্রসহ বিদেশী পিস্তল ছিল বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এছাড়া নয়া পাড়া ভিত্তিক জহির গ্রুপ, রহিমুল্লাহ গ্রুপ ও রাজ্জাক গ্রুপসহ আরো বেশ ক’টি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা সংগঠিত হয়ে রয়েছে। এরা পাহাড়ি এলাকায় গড়ে তুলেছে একাধিক আস্তানা। সেখানে পরিচালিত হচ্ছে সশস্ত্র প্রশিক্ষণও এমন তথ্য রয়েছে ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানীয় এলাকাবাসী ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তবে প্রাণভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।

রাতের বেলায় আইনশৃংখলা বাহিনী ক্যাম্পের প্রধান সড়কগুলোতে তৎপর হলেও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে অবস্থান নেয়। ফলে বড় ধরনের চিহ্নিত কেউ জালে ধরা পড়ছে না। যার ফলে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দারুণ আধিপত্য বিরাজ করছে। এসব সশস্ত্র গ্রুপকে কোথাও আরসা, কোথাও আল-অ্যাকিন নামে ডাকা হয়। তবে স্থানীয় ক্যাম্পে সাধারণ লোকজন গ্রুপ লিডারের নামেই এদের পরিচয় বহন করায় মনে হবে ছোট ছিনতাইকারী বা ডাকাত দল। আসলে কিন্তু এদের রূপ ভিন্ন। রাতের বেলায় তাদের চলাফেরা দেখলেই বুঝা যায় এরা কত সুসংগঠিত ও প্রশিক্ষিত। শিবিরের প্রতিটি ব্লকে রাত্রীকালীন পাহারাও চালু করেছে তারা।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর প্রথম দিকে আরসা নেতা ও সদস্যরা আত্মগোপনে ছিল। আবার কেউ কেউ স্থান পরিবর্তন করে ক্যাম্পেও অবস্থান নিয়েছিল। সম্প্রতি কয়েক মাসের মধ্যে ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে মিয়ানমারের মতো গঠন করা হয়েছে কমিটি। ধর্ম প্রচারের নামেও এরা এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে অবস্থান নিয়ে থাকে। সেখানে বসেই প্রয়োজনীয় শলাপরার্মশ করে থাকে তারা।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে সংঘবদ্ধ ছিল। সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর গ্রথম দিকে কৌশলী আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। পরে তারা আস্তে আস্তে শিবিরে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ক্যাম্পের হেড মাঝি, ব্লক মাঝি ও সাব-মাঝিগুলোর ৯০ ভাগই আরসা সমর্থক বা সদস্য। তবে মিয়ানমারের প্রতি গ্রামের গ্রুপ নেতারা এখানে দায়িত্ব না নিয়ে আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। ক্যাম্পের বিচার-শালিস থেকে পান থেকে চুন খসে পড়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।

ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবুল কালাম জানিয়েছেন, ক্যাম্পে যাতে আইনশৃংখলা ঠিক থাকে সেই জন্য পর্যাপ্ত আইনশৃংখলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। এছাড়া ক্যাম্পভিত্তিক মোটিভেশন ওয়ার্কও চলছে যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধী তৈরি হতে না পারে।

সূত্র : দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!