Home | উন্মুক্ত পাতা | যে বার্তা দিল আবরার হত্যা মামলার রায়

যে বার্তা দিল আবরার হত্যা মামলার রায়

অধ্যাপক শাব্বির আহমদ : দুই বছর পর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দিয়েছেন। অবশ্য মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হতে উচ্চ আদালতের অভিমত লাগবে, যা সময় সাপেক্ষ। তবে দণ্ডিতরা প্রকৌশলী তো হতে পারল-ই না; তাদের জীবন হয় অবসান, না-হয় বিপর্যস্ত হয়ে গেল চিরতরে।

কুষ্টিয়ার মেধাবী সন্তান আবরার ফাহাদ বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য অচেনা শহর ঢাকায় এসে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলো, কিন্তু তাকে ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। আবরারের মা-বাবা কখনো ভাবেননি তাঁদের সন্তান লাশ হয়ে ফিরে যাবে, ভেবেছিলেন ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। একইভাবে যারা আবরারকে খুন করেছে, তাদের মা- বাবাও সন্তানকে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন মানুষ হতে। তাঁরা কখনো ভাবেননি, তাঁদের সন্তান খুনি হবে। ফলে নিহত আবরারসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর বিরাট স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে এই রায়ে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে আসামিরা যোগসাজশে একে অন্যের সহায়তায় ছাত্রশিবির সন্দেহে আবরারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। মারধরের একপর্যায়ে আবরার বমি করে দেন, প্রস্রাবও করে ফেলেন। পরে তাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে ফের মারধর করা হয়। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে কান দেয়নি খুনিরা। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলার পরই ক্ষান্ত হয় তারা। তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, আসামিরা র‍্যাগিংয়ের নামে বুয়েটে আতঙ্ক বা একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং এর পূর্বেও একাধিক নৃশংসতা ঘটিয়েছিল।

আবরার ফাহাদকে হত্যার এমন নৃশংস বর্ণনা যখন সামনে আসে তখন খুনিদের প্রতি কোনপ্রকার অনুকম্পা ও সহানুভূতি আসার কথা নয়। রায়ে আবরারের পরিবার, রাষ্ট্রপক্ষ ও বুয়েট কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক- ছাত্রগণ সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাঁরা রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান- এমন প্রতিক্রিয়া সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। তবে ২৫ জন সম্ভাবনাময়ী তরুণকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার রায় অনেক বড় তাৎপর্য বহন করে। দণ্ডিতরা প্রাপ্তবয়স্ক, অপরাধের শাস্তি তাদের প্রাপ্য। তবে আমরা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের সেই মহাজনবাক্যও ভুলতে পারব না ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ নিহত আবরার আর দণ্ডিতদের পরিবারের আবেগ সহজেই বোধগম্য। সুতরাং এই দণ্ড দিয়ে হয়তো বিচারকও কাঁদছেন। বিচার সঠিক হয়েছে মেনে নিয়ে আম জনতাও কাঁদছে। কাঁদতে হয়, কারণ আমরা জানি, পাপকে ঘৃণা করতে হয়, পাপীকে নয়। কোনো মানবশিশু পাপী হয়ে জন্মায় না। এই ২৫ জন তরুণ সব সময় পাপী ছিলো না। পিতা-মাতা তাদের শিক্ষালয়ে পাঠিয়েছেন লেখাপড়া শিখতে, অপরাধী হতে নয়। বুয়েট বা অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অপরাধী বানায় না। ব্যক্তিগতভাবে উচ্চশিক্ষিত দু’চারজন ব্যক্তি অপরাধী হতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দল বেঁধে অপরাধী হওয়ার কারন খুঁজে বের করতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সাধারণত মধ্যবিত্ত- নিম্নধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়তে আসে। এদের সবাই কমবেশি মেধাবী। না হলে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী পাড়ি দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সাফল্য দেখাতে পারত না। শিক্ষার্থী ও তার পরিবার সবার চোখেই স্বপ্ন থাকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে শাণিত মেধার বিকাশ ঘটবে। কিন্তু কয়টি পরিবার খোঁজ রাখে ছাত্ররাজনীতির দুষ্টচক্রে পড়ে তাদের আদরের সন্তান, কারো ভাই, কখনও কখনও মেয়ে বা বোনটি বখে গেছে। পরিবারের সৌম্য শান্ত ছেলেটি ও মেয়ের স্বভাব- চরিত্রের রূপ যে পাল্টে গেছে ক্যাম্পাসে গিয়ে- ক’জনই তার খোঁজ-খবর রাখেন। এখন সে ঠিকাদার, দোকানদার এবং সতীর্থদেরও ত্রাস। সে অবলীলায় ভিন্নমতের বন্ধুদের ওপর হামলা করে। তাদের লাঠিপেটা- রডপেটা করে। বন্ধুর পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেয়। গুলি ছুড়ে ঝাঁজরা করে দেয় বুক। যেখানে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জাতির আলোর দিশারী হিসেবে নিজেদের তৈরি করবে, সেখানে তারা বখাটের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। একদল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বন্ধুদের ঘায়েল করতে তাদের পায়ের রগ কেটে দিয়ে পঙ্গু বানাতে দ্বিধা করছে না। অন্যদল চাপাতি-রামদা দিয়ে কোপাচ্ছে সতীর্থদের। কারও আগ্নেয়াস্ত্রের বুলেট বিদীর্ণ করছে বন্ধুর বুক।

আবরারের খুনের কারণ হিসেবে কেউ কেউ ভিন্নমত প্রকাশ রুদ্ধ করা ও র‌্যাগিং সংস্কৃতিকে দায়ী করলেও আমরা মনে করি, এই ব্যাধির শিকড় আরও গভীরে। এই দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রযন্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে। কোনো কিছুকে পরোয়া না করা কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বিদ্যমান, আবরার হত্যা তারই বহিঃপ্রকাশ। যাঁরা আবরারকে ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করেছে, তারা ধরে নিয়েছিল, তাদের কিছুই হবে না। কেননা, তাদের দল ক্ষমতায় আছে। অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলেও এমনটি ভাবা হতো। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কিংবা দায়মুক্তির সংস্কৃতি মানুষকে কতোটাই অমানুষ করে তোলে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আবরারের নৃশংস হত্যাকান্ড। অতীতে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী খুন হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ডামাডোলে এসব মামলা হারিয়ে যাওয়া তথা এসব ঘটনার বিচার না হওয়া ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। বিচার না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা গুলোকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিবেচনা করা, আদালতের ওপর রাজনৈতিক বা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তার, মামলা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেয়া, দীর্ঘদিনেও আদালতে প্রতিবেদন জমা না দেয়া, বাদীকে আদালতে হাজির হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আসামিপক্ষ কর্তৃক নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো, দীর্ঘদিনেও বিচার না হওয়ায় বাদী কর্তৃক মামলা পরিচালনা না করার মনোভাব সৃষ্টি হওয়া ও শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কাজ করে। শেষ পর্যন্ত বিচার না হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেকেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটাতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বিভিন্ন সময়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলতে শোনা যায় ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত হাজারও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন থেকে যায়, এখন পর্যন্ত কয়টি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেছে? এ কারণে অনেকেই তদন্ত কমিটিকে ‘ঘটনার ধামাচাপা কমিটি’ বা ‘ঘটনাকে ঠাণ্ডা করার কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও বলতে শোনা যায়, অপরাধী যে-ই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় বা হয়েছে, তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় নিঃসন্দেহে শিক্ষাঙ্গনে দাদাগিরি ও র‌্যাগিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্ট্রং এক মেসেজ। ছাত্র রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতির সাথে জড়িত তাদের জন্য একটি কড়া সতর্কবার্তা। শুধু শিক্ষাঙ্গন নয় আরো অনেক ক্ষেত্রেই এই মামলার রায়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে। দ্রুতই এই মামলার রায় হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি না থাকলে এ রায় আরও দ্রুত হতো বলে আমার জানিয়েছেন বিজ্ঞ কৌঁশলিগণ। এই মামলায় ৬০ জনের মধ্যে ৪৬ জন সাক্ষী দিয়েছেন। ছয় জন সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন। হলের কর্মচারিও সাক্ষী দিয়েছেন। চিকিৎসক সাক্ষী দিয়েছেন। ফলে ভবিষ্যতে অন্যান্য মামলায়ও সাক্ষীরা সহজেই নির্ভয়ে সাক্ষী দেবেন। আর সঠিক সাক্ষ্য- প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে যে বিচার পাওয়া যায় তা প্রমাণিত হলো। বুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর সত্য প্রাসাদ মজুমদারের বিবৃতিও প্রণিধানযোগ্য। ৮ ডিসেম্বর দুপুরে নিজ কার্যালয়ে রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা পরিচালনা করতে এ পর্যন্ত বুয়েটের প্রায় ৫৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আবরারের পরিবারের পক্ষ থেকে যেটুকু চাওয়া হয়েছে, তা আমরা দিয়েছি। মাসিক সাহায্য করছি। প্রতিমাসে পঁচাত্তর হাজার টাকা দিচ্ছি। তিনি বলেন, আইনি সহায়তা, আইনজ্ঞের ফি, স্বাক্ষী শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার খরচ, আনুষঙ্গিক সব খরচ, এমনকি ঢাকায় এসে থাকার খরচ, সবই আমরা বুয়েট থেকে বহন করেছি। প্রফেসর সত্য প্রাসাদ মজুমদার বলেন, দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত রায় আজকে আমরা পেয়েছি। উপাচার্যের এমন দায়িত্বশীল ও দৃঢ়চেতা মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাস্তানী আর খুনাখুনির বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে ভবিষ্যতে।

আবরার হত্যার মামলার রায়ের পর আবারো ছাত্র রাজনীতির পক্ষে- বিপক্ষে প্রশ্নটি চলে এসেছে।দু’পক্ষই ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার কথা বললেও আপাত সহজ কোন সমাধান কারোর কাছেই নেই। সুতরাং সেই বিতর্কে গিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে চাইনা। এতটুকু বলবো, শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে শিক্ষাঙ্গনে। ছাত্ররাজনীতির নামে এই অপরাজনীতি উচ্চশিক্ষালয়ে আসা শিক্ষার্থীকে শুধু লাশ করে না, খুনিও করে। অতএব, ছাত্ররাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি মেধাবী সন্তানদের লাশ ও খুনি বানায়, আমরা তার অবসান চাই। একইসাথে আমাদের প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র শিক্ষক কাউকেই যেন রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বলি না হতে হয় এবং সকল ক্ষেত্রে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!