Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | নুসরাতের গায়ে যেভাবে আগুন দেওয়া হয়

নুসরাতের গায়ে যেভাবে আগুন দেওয়া হয়

image-124127

নিউজ ডেক্স : ৬ এপ্রিল। নুসরাত জাহান রাফিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে নিয়ে যান ভাই মাহমুদুল হাসান। প্রধান ফটকে নুসরাতকে প্রবেশ করিয়ে বড়ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুর রহিমের কাছে জানতে চান তার বোন পরীক্ষার সিটে বসেছে কিনা? পরে জানানো হয় নুসরাত শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। এ সময় ভেতরে পরীক্ষা চলছে জানিয়ে তার ভাইকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

৭২২ পৃষ্ঠার চার্জশিটে এমনই উল্লেখ্য করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার নুসরাত হত্যা মামলার সর্বশেষ তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে সাংবাদিকদের জানান সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। চার্জশিটে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে হত্যার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদ্রসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলার নির্দেশে ৬ এপ্রিল সকাল সাতটার দিকে আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরু উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদরাসা প্রাঙ্গণে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যান।

আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেন। কামরুন্নাহার মনি কেনা দুইটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটিসহ মোট তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখেন।
শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করেন। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বে অবস্থান করা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে বলেন, ছাদে তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে।

নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকেন। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলেন ও ভয় দেখান, নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সাথে ছাদে উঠলে আসামি কামরুননাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের, ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে ছাদে যায়।
ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি প্রদান করে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলেন। কিন্তু সে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়।

ওড়না দিয়ে হাত ও পা বাঁধা হয় : বাম হাত দিয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছনের দিকে নিয়ে আসেন। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দুভাগ করে ফেলেন। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলেন, অন্য অংশ দিয়ে আসামি জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলেন। আসামি জাবেদ পায়ে গিট দেন। সকলে মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখেন। কামরুন নাহার মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরেন এবং উম্মে সুলতানা পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরেন। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেন।

শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামেন, এরপর উম্মে সুলতানা পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে যান। ওই সময় পূর্বের শেখানো মতে কামরুন নাহার মনি উম্মে সুলতানা পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যান।

আগুন লাগিয়ে পরীক্ষা দিতে যায় তিনজন : কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান। আসামি জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলেন। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরকা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢোকেন। শাহাদাত হোসেন শামীম নিচে নেমে মাদরাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যান ও মাদরাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেন। আসামি জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদরাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যান এবং বোরকা ও হাত মোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেন।

আসামি নুরু উদ্দিন সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত ছিলেন। মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারারত ছিলেন।
আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা

হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালাতে থাকেন। নুসরাত জাহান রাফি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভান।

উদ্ধার হয়েছে সব আলামত : কেরোসিন তেল বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন এবং কাচের গ্লাস যা রাফির গায়ে অগ্নিদগ্ধ করার সময় তেল ঢালতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার সময় যে দেয়াশলাই ব্যবহার করা হয়েছিল সেটার কাঠি জব্দ করা হয়েছে। নুসরাতের হাতে লেখা  খাতা উদ্ধার করা হয়েছে, যাতে অধ্যক্ষ তাকে উত্ত্যক্ত করতেন সেটা উল্লেখ আছে। পুড়িয়ে মারতে যে কালো তিনটি বোরখা ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো তদন্ত কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!