ব্রেকিং নিউজ
Home | উন্মুক্ত পাতা | করোনাকালে সংসার শুরুর অভিজ্ঞতা

করোনাকালে সংসার শুরুর অভিজ্ঞতা

ওমর ফারুক : পানি গরম করতে জানি। ডিম সিদ্ধ করতে পারি। ভাতও রান্না করতে পারি। তবে কখনো পানি কম হওয়ায় ভাতে চাল থেকে যায়, আবার কখনো পানি বেশি হওয়ায় ভাত নরম হয়ে যায়। এতটুকু অভিজ্ঞতা নিয়ে এপ্রিলের এক তারিখ থেকে সংসার শুরু করি। সংসার বলতে আমার একার সংসার। মাঝেমাঝে কয়েকটা টিকটিকি এবং তেলাপোকা উপস্থিত হয়ে জানান দেয় এই সংসারে আমি একেবারেই একা নই। তারাও আছে।

লক ডাউন শুরু হওয়ার চার দিনের মাথায় আমাকে কর্মস্থলে ফিরতে হয় একটা ইউনিয়নে সরকারি ত্রাণ বিতরণের কাজ তদারকি করতে। চাকরি বাঁচাতে অনেকটা বাধ্য হয়ে আমার এই ফিরে আসা। ব্যাচেলর বাসা আমার। বুয়াকে গত মাসের পুরো টাকা দিয়ে সেই মাসেই ছুটি দিয়েছি। লক ডাউনের কারণে খাবারের হোটেলগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অন্য সময় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দুটো ভাত চেয়ে খেতে পারলেও এখন কেমন জানি জড়তা কাজ করে। নিজেকে উটকো মনে হয়। চেনা প্রতিবেশীদের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হয়, অনাহূত মনে হয়। বাধ্য হয়ে নিজেই রান্না করে খাওয়া শুরু করি। সকালে লেক্সাস বিস্কুট গরম পানিতে চুবিয়ে খেয়ে ত্রাণ দিতে চলে যাই। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল চলে আসে। বৈশাখের তপ্ত দুপুরে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপরও একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমাকে দুটো রান্না করতে হয়। একেক দিন ডিমের একেক আইটেম রান্না করি। রান্না ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক তারপরও খেতে খেতে নিজেকে উৎসাহ দিয়ে বলি, বাহ্, বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে।

গতকাল থেকে তো রোজা শুরু হয়েছে। দিনে খাওয়ার ঝামেলা এখন নেই। কিন্তু ইফতার তো বানাতে জানি না। অন্য বছরগুলোতে বেশ আয়োজন করে ইফতার করতাম। এবার আয়োজন নয়, প্রয়োজনের ইফতার নিয়ে খুশি আছি। অনেকে তো আমার সমানও পাচ্ছে না। তাদের কথা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আমার জীবন তো চলছে।

বিকেলে খাটের ছোঁয়া পেলেই শরীর অবশ হয়ে যায়। কখনো সখনো ঘুমিয়েও যাই। ঘুম ভাঙলে প্রায় দেখতে পাই এক জোড়া জালালি কবুতর বুক সেলফের উপর বসে বসে আমাকে পাহারা দিচ্ছে। আমার নিসঙ্গতায় যেনো কিছুটা সঙ্গ নিয়ে আসে কবুতরগুলো। ভালোবাসা নিয়ে তাদের দিকে আগালে তারা উড়ে যায়। তারা মানুষকে ভালোবাসতে জানলেও মানুষের ভালোবাসাকে তারা বিশ্বাস করে না। হয়তো জেগে থাকা আমার চেয়ে ঘুমন্ত আমাকেই তাদের পছন্দ। তাদের পেছন পেছন আমিও ব্যালকনিতে যাই। সারাদিন মাস্ক পরে থাকতে থাকতে নিশ্বাস নেওয়াটাই ভুলে যাই। বাইরের নিশ্বাসগুলোকেও এখন বিশ্বাসঘাতক মনে হয়। তাই এই সময়টায় ব্যালকনিতে গিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিই। সারাদিনের নিশ্বাসের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার যেন চেষ্টা করে যাই। নিশ্বাস নিতে নিতে একটা কাঠবিড়ালিকে ডাব চুরি করে খেতে দেখি। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে কোয়ার্টারের অনেক গাছে চোখ যায়। গাছগুলোতে আজ উৎসব লেগেছে।

মৃদু বাতাসে নারিকেল গাছের পাতার নাচন দেখি, অর্জুন গাছের উপর মানুষের হিংস্রতার চিহ্নগুলিও আস্তে আস্তে মুছে যেতে শুরু করেছে, নতুন পাতায় আমড়া গাছটা নাইয়রে আসা বউয়ের মতো করে সেজেছে, লালপাতা ঝেড়ে জলপাইগাছটা সবুজ পাতায় পোয়াতি হয়ে উঠেছে। পাখিরা তাদের সঙ্গীদের ডাকতে ডাকতে ঘরে ফিরতে শুরু করে। আমার তো কোথাও ফেরার তাড়া নেই। অন্ধকার নামলে, মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি আসলে ঘরে ঢুকে যাই।

উপজেলার কমপ্লেক্সের ওয়াকওয়ের লাইটগুলো আস্তে আস্তে জ্বলে উঠে। সেই আলোয় মেদ ঝরাতে আমি একাকী হাঁটি আর ভাবি, এভাবে আর কতদিন? মাসখানেক আগেও এখানে ওখানে কতো মানুষের হৈহল্লা ছিলো, উৎসব ছিলো কিংবা কত রকমের আয়োজন ছিলো। চোখে দেখা যায় না এমন একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের ভয়ে অন্দর বন্দর মাতিয়ে রাখা মানুষগুলো এখন দরজায় খিল এঁটে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। এই পৃথিবীটা যতটা আমার ঠিক ততটা বিকেলবেলা ঘুমন্ত আমাকে পাহারা দেওয়া জালালী কবুতর দুইটারও। ক্লান্ত প্রকৃতি দম নিবে, পাখিরা উড়বে, গাছগুলো ফুলে ফলে সাজবে বলেই হয়তো বিধাতা এই সময়টা এভাবেই লিখেছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের দেনাপাওনার হিসাব মিটে গেলেই হয়তো আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত হয়তো আমাদের ঘরেই থাকতে হবে। লেখক : সহকারী শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!