Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | বাংলাদেশে ‘আইস’ পাচারের নেপথ্যে মিয়ানমারের মাফিয়া

বাংলাদেশে ‘আইস’ পাচারের নেপথ্যে মিয়ানমারের মাফিয়া

নিউজ ডেক্স : মারণ বড়ি ইয়াবার মতোই দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আরেক ভয়ানক মাদক ক্রিস্টাল মিথাইল অ্যামফিটামিন বা আইস। নাফ নদীর ওপারের দেশ মিয়ানমার থেকেই ইয়াবার পাচার রুট হয়ে দেশে ঢোকানো হচ্ছে এ মাদক, যার পেছনে কাজ করছে সেখানকার মাফিয়া চক্র। এ মাদক চোরাচালানে যুক্ত দেশটির কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও।

দেশের অভ্যন্তরে শক্ত যোগাযোগ অগণিত অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে উচ্চবিত্তের টার্গেট করে আইস ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যুব সমাজে। দেশেরও একদল অসাধু এ কাজে সম্পৃক্ত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা ট্যাবলেটের পর বাংলাদেশে আইসের বড় একটি বাজার তৈরিতে নানা পায়তারা করছে মিয়ানমারের মাফিয়ারা। এসব মাফিয়াদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দেশেরই কিছু মাদক কারবারি, যাদের লক্ষ্য একটাই- অধিক থেকে অধিকতর অর্থ আয়। যারা আগে ইয়াবা নিয়ে কারবারি করত, তারা এখন আইস বিক্রিতে ঝুঁকে পড়েছে।

কোথায় উৎপাদিত হয় ক্রিস্টাল মেথ-
আগে উত্তর আমেরিকায় ক্রিস্টাল মেথ বা আইস মাদক উৎপাদিত হতো। ২০১৫ সাল পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা ছিল আইসের মূল উৎপাদনকারী অঞ্চল। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে এ মাদক উৎপাদিত হচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আইস ল্যাব স্থাপনের প্রবণতা বেড়েছে। এ মাদক উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরান, চীন, আফগানিস্তান ও মিয়ানমার। এশিয়ায় আইসের বড় বাজারও তৈরিতে এগিয়ে আছে মিয়ানমার।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্রিস্টাল মেথ মাদক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মিয়ানমার ভিত্তিক কয়েকটি সন্ত্রাসী চক্র (মিয়ানমার ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন এবং দেশটির সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ)। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশের মাদক মাফিয়ারা। মিয়ানমারের শান স্টেট থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে আইস আসে বাংলাদেশি সীমান্ত এলাকায়। আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়ারাও এতে সম্পৃক্ত।

২৮টি রুটে আইস আসে বাংলাদেশে। এরপর কক্সবাজার ও টেকনাফের কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় এ মাদক। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের জেলেদের মাছ ধরার ট্রলারের করেও এ মাদকের চালান ঢুকছে দেশের অভ্যন্তরে। দেশে যারা আইস নিয়ে কারবার করে থাকেন, তারা শুধু মাত্র বেশি অর্থের কারণেই যুব সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাদা বর্ণের মাদকটিকে।

গোয়েন্দারা বলছেন, দেশে যে ২৮ কায়দায় আইস ঢোকে তারমধ্যে একটি হলো- জেলের ছদ্মবেশে নৌকাযোগে মাছের আড়ালে নিয়ে আসা। এ ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মাঝে নাফ নদী পার করেও নিয়ে আসা হয় আইস। চালান অদল-বদলের কাজগুলো ঘটে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারে। এরপর শাহ-পরীর দ্বীপ, হাতিয়া হয়ে নৌ-পথে এ মাদক চলে আসে ঢাকায়। একই কায়দায় মাদক সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নৌপথে বরিশাল ও পটুয়াখালী হয়েও এ মাদকের কারবারি হয় দেশে।

আইস মাদক পাচার রোধে নির্বিকার মিয়ানমার-
মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা ও আইস ঢুকছে। এ নিয়ে দেশটির সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশি বাহিনীর একাধিক আলোচনাও হয়েছে। তার পরও এ বিষয়ে তাদের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত দেশটিকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার বা দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেও মাদক চোরাচালান বন্ধে কোনো কিনারা করতে পারেনি।

সম্প্রতি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের প্রধান দুটি মাদক উৎপাদনকারী বলয়ে অবস্থিত। যে কারণে এটি মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারত থেকে অনেক ভয়ঙ্কর সব মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। আমরা তাদের সব সময় অনুরোধ করেছি। আমাদের অনুরোধে তারা সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিল কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। যে দুয়েকটি আছে তাও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এদিকে মিয়ানমার থেকে মাদক আসছে।

এসব মাদক বন্ধ করতে আমরা সেখানকার সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেছি। তারা মাদক চোরাচালান বন্ধের বিষয়ে অনেক কিছুই বলে, কিন্তু কিছুই করেন না।

এ কারণে আমরা আমাদের সীমান্তে বিজিবিকে শক্তিশালী করছি। আমাদের কোস্ট গার্ডকে শক্তিশালী করছি। মাদক যাতে দেশে না ঢুকতে পারে সেদিকে নজরদারি করছি। আমরা সীমান্ত এলাকায় সেন্সর বসানোর ব্যবস্থা করছি, যাতে কেউ আসলে বা গেলে তার অস্তিত্ব আমরা টের পাই, যোগ করেন মন্ত্রী।

গত ১৯ জুন রাতে পশ্চিম রসুলপুর বাগান বাড়ি এলাকা থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টার মেথ বা আইসসহ লাবনী বেগম নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ। অভিযানে ৫ গ্রাম আইস ও এক হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।

গত ১৮ জুন দুপুরে রাজধানীর দোবাদিয়া ব্রিজের পূর্ব পাশে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ও আইসসহ মো. রাজিব নামে এক কারবারিকে গ্রেফতার করে উত্তরখান থানা পুলিশ। রাজিবকে তল্লাশি করে ৭০০ পিস ইয়াবা ও ২৫ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়। এ বিষয়ে উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার রাজিব উত্তরখান এলাকায় ইয়াবা ট্যাবলেট কারবারি। সে একই সঙ্গে আইসের কারবারও করে আসছিল।

গত ২৮ এপ্রিল রাতে দমদমিয়া বিওপির দায়িত্বপূর্ণ বিআরএম-৮ আওতাধীন নাফ নদীর জালিয়ারদ্বীপ এলাকার অভিযান চালিয়ে একটি বস্তায় ১ কেজি ৪০ গ্রাম আইস ও ৪০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি। একই সঙ্গে মো. সিরাজুল ইসলাম (২৮) ও সৈয়দ সালাম (৩৮) নামে দুজন মাদক কারবারিকে আটক করা হয়। অভিযানের পর কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা এক চোরাকারবারি সাঁতরে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জালিয়ারদ্বীপে থাকা এক জেলের কাছে এসে একটি বস্তা হস্তান্তর করে। এসময় বিজিবি টহল দল দুই চোরাকারবারিকে চারিদিক থেকে স্পিড বোটের মাধ্যমে ঘেরাও করে ফেলে। পরে তল্লাশি করে তাদের কাছ থেকে ১ কেজির বেশি আইস ও ৪০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। আটক দুজনই মিয়ানমারের নাগরিক।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, ২০০৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ আইস মাদকের চালান ধরা পড়ে। সে সময় এ মাদক সম্পর্কে কেউ কিছুই জানতে না। একযুগ পর ২০১৯ সালে আবার এ মাদক আসতে শুরু করে বাংলাদেশে। বর্তমানে রাজধানীসহ কয়েকটি বিভাগের শহরাঞ্চলে আইস সেবনের কিছু গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। সেবনকারীদের বেশিরভাগই বিত্তশালী পরিবারের সদস্য। অপরদিকে এ মাদকের কারবারে যারা জড়িয়েছেন বা জড়াচ্ছেন তারাও অর্থ-বিত্তশালী। তারা প্রথমেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে আইস মাদকের বাজারজাতের চেষ্টা চালাচ্ছে।

ভয়াবহ মাদক আইস ১০ থেকে ১২ বার সেবনে একজন মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে। স্মরণশক্তি, মনোযোগ হ্রাস পাওয়াসহ কলহ প্রবণতা ও আক্রমণাত্মক মনোভারের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, আইস মাদক সেবনে বেড়ে যায় আত্মহত্যার প্রবণতাও। মিয়ানমার থেকে আসা মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট থেকেও ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী ও ক্ষতিকর সাদা বর্ণের এ মাদক।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (এডি) মেহেদী হাসান বলেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আইস ধরা পড়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রথম আইস তৈরির ল্যাবসহ আসামি গ্রেফতার করে। আমরা প্রতিনিয়ত এ মাদকসহ অন্যান্যগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। এটি যাতে ইয়াবার মতো বিস্তার ঘটাতে না পারে; সেজন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখবো। -বাংলানিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!