খুন

1

ওমর ফারুক : রবিনকে আমরা খুন করে ফেললাম। আমরা বলতে জহরলাল, রাজীব আর আমি। রবিন ছিল আমাদের মাঝে সবচেয়ে সহজ-সরল। ‘ভাত দিলে খায়, ডাইল দিলে চাইয়া থাকে’ এমন। কোন দিন যে আমরা খুনের আসামী হবো, বন্ধুর রক্তে হাত লাল হবে কখনো ভাবি নাই। নির্মম বাস্তবতা হলো আমরা এখন খুনি। কিছুক্ষণ পর রবিনের মরে যাওয়ারর ব্যাপারটা জানাজানি হবে, পুলিশ কোমরে দড়ি দিয়ে আমাদের বেধে নিয়ে যাবে, ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। থানা, পুলিশ, জেলের চৌহদ্দি জীবনে কখনো না মাড়ালেও রবিনের জন্য একটু পর জেলে যেতে হবে। হালার্পুটা সবসময় ত্যাড়ামি করে, জিততে চায়। আরে বাবা, যা বলছি তা মাইনা নিলে তো হত। না, তা সে করবে না। জিদ মারানো লাগবে তার। মইরা এখন বুঝো ঠ্যালা! তার জন্য আমাদেরও ঠ্যালা বুঝতে হবে। সেটা খারাপ লাগছে।

রবিনের সাথে আমার বন্ধুত্ব কবে তার দিনক্ষণ মনে না থাকলেও একবার টিকেট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণে পরিচয় হয়েছিল সেটা মনে আছে। ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে যেখানটাই জোড়া লাগানো থাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে স্টার সিগারেট ফুঁকছিলাম। কোন গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই সে বলল,’ ভাই, বিড়িটা ফালাইয়া দিয়েন না। শেষ টানটা আমারে দিয়েন’। অপরিচিত কেউ আচানক একটা কিডনি দেওয়ার বিনীত অনুরোধ করলে যেমন লাগার কথা, আমারো তেমন লেগেছিল। কত আয়েশ করে ট্রেনে দুলতে দুলতে সিগারেটটা টানতেছিলাম আর হালার্পুটা কিনা বলে, সিগারেটের লাস্ট টানটা তারে দিতে। মুখ ভার করে তার দিকে তাকালাম। একজন বিড়িখোরের কাছে কেউ বিড়ি চাইলে না করতে পারে না। বিড়ির তেষ্টা বুঝে বড্ড মায়া হল। দিয়ে দিলাম সাধের শেষ টানটা।

আগ বাড়িয়ে সেই পরিচয় দিল- ভাইজান, আমি রবিন। জগন্নাথে পড়ি। বাড়ি বোয়ালখালী’। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। তবে কেউ বললে আমি জমিয়ে আড্ডা দেই। এমনও গেছে আগ বাড়িয়ে কথা না বলায় অনেকের সাথে সারাদিন একসাথে থেকেও একটু হাই হ্যালো পর্যন্ত করি নি। সে আগবাড়িয়ে কথা বলায় ভাবলাম, রবিনের সাথে কথা বলা যায়। এমননিতে এই বগি সেই বগি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেদিনগল্প করতে করতে আমরা বন্ধু হয়ে গেছিলাম।

রাজীব আমার কলেজের বন্ধু। সে ছিল ‘চ’ সেকশনে আর আমি ‘ঙ’ তে। কম্বাইন্ড ক্লাস সমাজবিজ্ঞান করতে গিয়ে তার সাথে পরিচয়। পারুর সাথে তখন চুটিয়ে প্রেম করত সে। রাজীবের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে পারুর প্রেমে আমিও পড়েছিলাম। আমার সেকশনেই পারু ছিল। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য হোস্টেলের বেসিনের সামনে পানি দিয়ে চুল স্ট্রেট করে ক্লাসে যেতাম। পরে যখন জানলাম পারু আগেই রাজীবেই ইমপ্রেসড আছে, বমি করার জায়গা না পেলে মানুষ বাধ্য হয়ে নিজের বমি নিজে গিলে ফেলার যেরকম চেষ্টা করে, পারুর প্রতি আমার অব্যক্ত ভালবাসাও সেভাবে গিলে ফেললাম। যাকগে, সেইসব দিনের কথা।

এই ঈদের পরে পারুর সাথে রাজীবের বিয়ে। দাওয়াত আগেই পেয়েছি। হানিমুন ‘সাইরো’তে করার প্লান তারা করেছে । সাইরো যাওয়ার বুদ্ধি আমি অবশ্যই দিয়েছি। একদিন পারুকে বললাম, তোমরা হানিমুন করলে সাইরোতেই করিও। পরে সে রাজীবকে সাইরো যাওয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেলল। জীবনে পারুকে প্রেমে ইমপ্রেস করতে না পারলেও হানিমুনের জন্য বান্দরবান অফার দিয়ে তাকে ইমপ্রেস করতে পেরেছি। রাজীব কোথায় পারুকে নিয়ে সাইরো যাওয়ার কথা ভাববে, এখন তাকে কিনা ভাবতে হচ্ছে জেলে যাওয়ার কথা। বেচারি পারুর জন্য খারাপ লাগছে। এক রবিন আমাদের সবার জীবনের নকশা পাল্টে দিল।

মেস থেকে বাহার চলে যাওয়ায় গুলজার মোড়ে ‘টু লেট’ লিখে পোস্টার সেঁটে দিলে জহরলালকে আমরা রুম মেট হিসেবে পাই। সে কারো সাতেও নাই, পাঁচেও নাই। ছুটির দিন ছাড়া সকালে কখন সে বেরিয়ে যেত কিংবা কখন আসত আমরা কখনো দেখতাম না। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম তার রুমে কাঁঠালের কোষার মত একটা হলুদ বর্ণের পিতলের তালা ঝুলছে আর প্রতিদিন রাত বারোটার দিকে ফিরে দেখতাম তার রুম ভিতর থেকে শিটকিনি দেওয়া। শুনেছি একটা প্রকাশনা হাউজে চাকরি করত এবং বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ করত। প্রতি মাসে বাড়িতে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ও ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখার জন্য তাকে টাকা পাঠাতে হত। টানাপোড়নের জীবনে তার এত ঘুরাঘুরির সময় ছিলনা। রবিনের মৃত্যু জহরলালের জীবনে নিশ্চয় ছন্দপতন ঘটাবে, সে এখন তার অসুস্থ মাকে টাকা পাঠাতে পারবে না।

চাকরির জন্য কয়েকবার ট্রাই করে কোন সুবিধা করতে না পেরে এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি কলিং বেল টিপি । কেউ ফোন করে কোথায় আছি জিজ্ঞেস করলে ভাব নিয়ে বলি, অফিসে ব্যস্ত আছি। নিজের সাথে নিজের অভিনয় আরকি। আমার এক স্টুডেন্ট ইশরাকের বোন ভার্সিটিতে পড়ে। মাঝেমাঝে দরজা খুলে দিলে চোখাচোখি হয়। কেন জানি কৈশোরের লাগামছাড়া প্রেম আবার জেগে উঠে। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই, শফিক কন্ট্রোল ইউরসেল্প। তুমি এখানে ইট ভাঙ্গতে এসেছো। প্রেম প্রেম খেলতে নয়। অবশ্যই একটা চাকরি পেলে ইশরাকের বোন ইশরাতকে একবার ট্রাই করা যেত। হয়ত লেগেই যেতে পারে। ইশরাতকে পাওয়ার জন্য ইদানীং সিরিয়াসলি আবার চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছি। এই বয়সে পড়াশোনা মাথায় না ঢুকলেও ইশরাত আমাকে পাগল করে দিয়েছে। রবিন বেটাটা মরে গিয়ে ইশরাত আর আমার মাঝে জেলের গরাদ টেনে দিয়েছে। আরে বেটা একটা ঘুষি দিলে কি মরে যেতে হয়। ইশরাতটা হয়ত হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি করলেও রবিন সারাক্ষণ জিআরই এর পেটমোটা বই নিয়ে পড়ে থাকত। ট্রাম্পের দেশে গিয়ে মরে যেতে পারলেও নাকি তার জীবন সার্থক হবে আমাদের বলে বেড়াতো। শালা শখ করেছিল আমেরিকায় গিয়ে মরার , সে কিনা এখানে মইরা আছে। নিজেদের উপর রাগ হচ্ছে। রবিইন্নার উপর তো আরো বেশি।

একই ছাদের নিচে আমরা চারজন থাকলেও আমাদের স্বপ্নরা ভিন্ন ভিন্ন। এক রবিন মরে গিয়ে পারুর সাথে রাজীবের বিয়ে, ইশরাতের সাথে আমার কুসুম কুসুম প্রেম হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা, জহরলারের তার মাকে সুস্থ করার ব্যতিব্যস্ততা কিংবা রবিনের ট্রাম্পের দেশে গিয়ে মরার ইচ্ছেটাকে এক কুণ্ডলীতে নিয়ে এসেছে।

‘শফিক ভাই, এটা কি হল? এভাবে কেউ ঘুষি মারে?’ জহরলাল আমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল।

‘আরে দাদা, আমি কি ইচ্ছে করে মেরেছি? শালা থ্যাড়ামি করায় চোখে আন্ধার দেখছিলাম। আমি কি জানতাম এক ঘুষিতে সে মরে যাবে?’

‘দেখ ভাই, ঈদের পরে আমার আর পারুর বিয়ে। বিয়ের পরে পারুকে নিয়ে ‘সাইরো’ তে হানিমুনে যেতে হবে। তোদের এসব খুন খারাবির মধ্যে আমাকে জড়াইস না’। রাজীব যেন কিছুই করে নাই বলল।

কেউ দায় এড়াতে চাইলে মাথা ঠিক থাকে না। এমনি রবিনের লাশ কি করব তা নিয়ে চিন্তায় আছি তার উপর রাজীবের বাচ্চার কথা শুনে মাথায় দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠল। দেওয়ালের সাথে রাজীবের মাথা ঠেকিয়ে বললাম,

‘শালার পুত কি বললি তুই? হানিমুন মারাচ্ছো না? হানিমুন একদম সারাজীবনের জন্য ভইরা দিমু। তোর জন্যই তো রবিনকে মারতে গেলাম।’

‘আমি কি বলছি রবিনকে মেরে ফেলতে?’ রাজীব ভয়ার্ত চোখে ছেড়ে দেওয়ার মিনতি করতে করতে বলল।

‘রবিন যে পারুকে প্রপোজ করত, তোর বিরুদ্ধে গুটিবাজি করত সেটা নিয়ে তুই তো নালিশ করেছিলি? পারু মাগী আমার কি হয়? তুই বলাতেই তো রবিনকে জেরা করেছিলাম।’ রাগে রাগে গরগর করতে করতে রাজীবকে বললাম।

রাজীব চুপ হয়ে যায়। সে কাঁদতে শুরু করে দেয়। তার কান্না আমাকে টলাতে পারে না। আমি জহরলাল দাদাকে বললাম,

‘দাদা, বাসায় একটা বস্তা পাওয়া যায় কিনা দেখেন। লাশের একটা বিহিত তো করতে হবে।’

একটা মাছি ভনভন করছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। দু একবার মারতে গিয়েও মাছিটাকে মারতে পারি নাই। পরে সেটা রবিনের মুখে গিয়ে বসল। রবিন মশা মাছি সহ্য করতে পারতো না। এখন তার মুখে মাছিটা বসে আছে অথচ কোন প্রতিবাদ নাই। হু হু করে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল বাইম মাছের মত করে। যে বন্ধুর সাথে আমাদের এত দিনের সম্পর্ক তাকে কিনা আমি…।

কিভাবে কায়দা করে, রবিনকে আর আঘাত না দিয়ে মাছিটা মারা যায় তা নিয়ে ভাবছিলাম। জহরলাল দাদা একটা ব্রিফকেস নিয়ে আসে রবিনের রুম থেকে। রাজীব ঝিম ধরে বসে আছে। মাছিটাকে কোন রকম সরিয়ে ব্রিফকেসে লাশটা ঢুকাতে যাবো এমন সময় কলিংবেলের বেজে উঠল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সবার আগে দৌড়ে গিয়ে রাজীব দরজা খুলে দিল। দেখি পুলিশ এসেছে। সে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলা শুরু করল,

‘স্যার, এরা দুজনই রবিনকে মেরে ফেলেছে। আমার ভালো বন্ধুটাকে তারা নির্মমভাবে মেরে ফেলছে। তারা লাশ গুম করে ফেলতে চেয়েছিল। তাদের যেন কঠিন শাস্তি হয়। সামনে আমার বিয়ে। আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে তারা। আপনারা তাদের কথা শুনবেন না।’

রাজীবকে আগ বাড়িয়ে পুলিশ ডাকতে দেখে বুঝলাম সে ই পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশ নাইলনের দড়ি দিয়ে আমাদের বেধে কুরবানির গরুর মত টানা শুরু করেছে।

একটা বিশ্বাসঘাতক আবিস্কার করতে পারার সুখে আমরা অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ালাম।

লেখক : সহকারী শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!