
অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে রক্ষা পাওয়া স্কুল ছাত্র আরিফুল ইসলাম
নিউজ ডেক্স : মোঃ আরিফুল ইসলাম। উজিরভিটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ও উপজেলার দক্ষিণ লোহাগাড়া হাজির পাড়ার আবদুর রহিমের পুত্র। গত ১ অক্টোবর ২০১৮ ইং বাড়ি হতে স্কুলে যাবার পথে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছে। ৩ অক্টোবার ২০১৮ ইং নিজ বাড়িতে ফিরেছে। তবে কোথায় ছিল, কিভাবে গেছে সেটা তিনি জানে না।
স্কুল ছাত্র আরিফুল ইসলাম জানায়, ঘটনারদিন স্কুলে যাবার পথে কয়েকজন অপরিচিত লোক তাকে ডাকে। যাবার সাথে সাথে নাকে-মুখে একটি রুমাল দিয়ে চেপে ধরে। এরপর তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পায় সে একটি বেড়ার ঘরে বন্দি। ওখান থেকে কৌশলে বের হয়ে অনেক দূর হেঁটে এসে দেখতে পাই ‘হারবাং’ নামক সাইনবোর্ড। পরে সে গাড়িতে করে নিজ বাড়িতে চলে আসে।

অপরদিকে দৈনিক পূর্বকোণ সূত্রে জানা যায়, আরিফ উদ্দীন (১৭) ও আসলাম উদ্দীন (১৪) দুই ভাই। নগরীর শুলকবহর মাদ্রাসা থেকে হাটহাজারী সদরের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হয়। তার চাচা দুই ভাতিজার সন্ধানপ্রার্থী হয়ে ফেসবুকে ছবিসহ পোস্ট দিয়েছিলেন। এছাড়া পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডিও করেন। কিন্তু ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও দুই সহোদরের হদিস পাচ্ছে না।
নগরীর পাহাড়তলী দাখিল মাদ্রাসা থেকে গত ৪ অক্টোবর সকালে নিখোঁজ হয় লাকাদ নামের ১২ বছরের এক শিশু। নিখোঁজের এই সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে ভাইকে উদ্ধারে জনগণের কাছে সহযোগিতা চায় বোন জান্নাতুল নাইম ইলমা। দুই দিনের ব্যবধানে ফেসবুকেই তিনি পোস্ট দিয়ে অবহিত করেন নিখোঁজ ভাইকে পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে আটক করা হয়েছে অপহরণকারীকে।
এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর নগরীর হালিশহর থেকে অপহরণের ৬ দিন পর হালিশহর আল-জামিয়া ইসলামিয়া বাইতুল করিম মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র জাশেদুল ইসলাম (১৪)-কে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশ চাঁদপুর শহরের বিপণীবাগ হতে উদ্ধার করে। উদ্ধারের পর জাশেদুল জানায়, ৫ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় নগরীর হালিশহর এলাকায় তাদের এ ব্লকের বাসা থেকে বের হয়ে বি ব্লকের কাছে আসলে দু’জন যুবক তাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। একপর্যায়ে জাশেদুল বাসে উঠলে দুই যুবকও বাসে উঠে। কিছুদূর যাওয়ার পর বাস থেকে সব যাত্রী নেমে গেলে জাশেদুল নামার সময় যুবকরা তার নাকের কাছে তুলাসহ আতর ধরলে জাশেদুল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর আর সে কিছু বলতে পারে না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সে বুঝতে পারে অজ্ঞাত একটি স্থানে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। এখানেই সে পাঁচ দিন আটক ছিল। একদিন, সুযোগ বুঝে জাশেদুল ওই ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসে এবং এক সবজি বিক্রেতাকে তার ঘটনা জানায়। সেই সবজি বিক্রেতা ছেলেটিকে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
একইভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ভাগ্যক্রমে মাহমুদুর নামে কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রকে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে তার পরিবার। ঈদুল আযহার আগে এক শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে বেরিয়ে বাসায় আসার পথে নিখোঁজ হয় মাহমুদুর। তার পরিবার হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাকে। গভীর রাতে নগরীর গরীব উল্লাহ শাহ মাজার এলাকা থেকে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় ১৫ বছর বয়সী ছেলেকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা। তার অভিভাবক সূত্রের ধারণা, ঘটনার পরপরই বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করার পর পুলিশি তৎপরতার মুখে অপহরণকারীরা হয়তো মাহমুদুরকে ফেলে রেখে চলে যেতে বাধ্য হয়। মসজিদ থেকে বের হবার পর কিভাবে সে গরীব উল্লাহ শাহ মাজার এলাকায় এসেছে, সেটি এখনও মনে করতে পারছে না মাহমুদুর। নিখোঁজ হওয়ার ১৫ ঘণ্টা পর উদ্ধারের সময় তার চোখে-মুখে ছিল রাজ্যের ঘুম। চোখ খুলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার। অপহরণের সময় তাকে অজ্ঞান করে তুলে আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারও আগে ২ জুলাই নগরীর চকবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন শিশুসহ ২ মানবপাচারকারীকে আটক করে র্যাব-৭।
এভাবে একের পর এক প্রায় কিশোর বয়সীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নগরীতে। কারা, কি উদ্দেশ্যে কিশোর বয়সীদের টার্গেট করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কেউই সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারছে না। যাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই আবার মাদ্রাসা ছাত্র।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, গত ২৪ সেপ্টেম্বর লাভলেন এলাকায় মামুনুর রশীদ মামুন নামে এক পাচারকারীর কাছ থেকে তিন শিশুকে উদ্ধার করা হয়। তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। এসব শিশুকে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে একটি হোটেলে রাখা হয়েছিল। উদ্ধারের পর শিশুগুলো কোনমতে তাদের নামটি বলতে পেরেছিল। তিনি বলেন, আটক পাচারকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, সে নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুদেরকে কৌশলে চুরি করে। পরে তাদেরকে ঢাকায় বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিক্রি করে দেয়। এসব শিশুদের দিয়ে মূলত কাজ করানো হয় বলে পাচারকারী স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে দেশের বাইরে পাচার করে দেয়া হয়।
কিন্তু পাচারকারীর এই বক্তব্য অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কৌশলে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর সেসব শিশুদের দিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজ করানোর বিষয়টি অবিশ্বাস্য। কারণ পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুটি সহজে কাজ করতে চাওয়ার কথা নয়। কান্নাকাটি করা কিংবা সুযোগ বুঝে কাউকে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বলে দেয়ার কথা। এমন ঝুঁকি নিয়ে দোকানদার কোনো শিশু-কিশোরকে দিয়ে দোকানে কাজ করাবেন, এটি মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তবে দেশের বাইরে পাচার করে দেয়ার বিষয়টি ভিন্ন।
অভিভাবকদের অনেকের কাছে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলো প্রায় কিশোর বয়সীদের কেন চুরির জন্য টার্গেট করা হচ্ছে। আবার যাদের চুরি কিংবা অপহরণ করা হচ্ছে, তারা প্রায় সকলেই মাদ্রাসার ছাত্র।
এ বিষয়ে অবশ্য কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, মাদ্রাসার কয়েকটি ছাত্র বেটারি গলি এলাকা থেকে কিছুদিন আগে নিখোঁজ হয়। পরে তদন্ত করে দেখা যায়, মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে চায় না বলে তারা নিখোঁজ নাটক ফেঁদে বসে।
এদিকে, শুলকবহর মাদ্রাসা থেকে হাটহাজারী সদরের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হওয়া আরিফ উদ্দীন (১৭) ও আসলাম উদ্দীন (১৪)-এর হদিস এক মাসে মেলেনি। এই ঘটনায় জিডির পর পাঁচলাইশ থানার এসআই সোবহান এ বিষয়ে তদন্তে নামে। গতকাল রাতে পূর্বকোণ প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে মো. সোবহান জানান, দুই ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবারের মাধ্যমে সংবাদপত্রে একটি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তি প্রচারের পর কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। উল্টো প্রতারণামূলক বহু ফোন আসতে থাকে। ‘অমুক জায়গায় আছে, এত টাকা দিয়ে নিয়ে যান’- এই জাতীয় ফোনও পাওয়া যায়। প্রতারণামূলক এসব ফোনকল পাওয়ার পর আমরা সেই উদ্যোগ থেকে সরে আসি। এসআই সোবহান বলেন, আমি ছুটিতে আছি। ৯ অক্টোবর কাজে যোগ দিয়ে আবার হারিয়ে যাওয়া দুই ভাইকে খুঁজবো।