ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | সরকারি ভাতা উত্তোলনে হয়রানির শেষ নেই!

সরকারি ভাতা উত্তোলনে হয়রানির শেষ নেই!

নিউজ ডেক্স : মোহাম্মদ হোসাইন (৪৭) একজন প্রতিবন্ধী। লোহাগাড়ার পুটিবিলা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের গোরস্তান নয়াবাজার এলাকার ছালেহ আহমেদ এর পুত্র তিনি। সোনালী ব্যাংক লোহাগাড়া শাখা থেকে তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা উত্তোলন করেন। বাড়ি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে প্রতি তিন মাস কিংবা ৬ মাস অন্তর শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে ভ্যানে করে ভাতা উত্তোলন করতে যান। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

অভিযোগে বলেন, ‘একবার গিয়ে আমি ভাতা উত্তোলন করতে পানি না। ম্যানেজার নেই, ব্যাংকে যিনি এটা নিয়ে কাজ করে তিনি আজকে আসেননিসহ নানা অজুহাতে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। এ কারণে একবার ব্যাংকে গেলে তার ৫০০ টাকা ভ্যান ভাড়া চলে যায়।’ এ অভিযোগ শুধু মোহাম্মদ হোসাইনের নয়, ভাতা উত্তোলনকারী অনেকের। সরকারি ভাতা প্রদানে ব্যাংক সমূহের বিরুদ্ধে ভাতাভোগীদের হয়রানির অভিযোগ এবার নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে অভিযোগ উঠে আসছে। চলমান করোনা সংকটে এটি আরো প্রকট হয়ে উঠেছে।

ব্যাংকগুলো বর্তমানে দৈনন্দিন কার্যক্রমে গ্রাহকের টাকা জমা ও প্রদান ছাড়া ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে গরিমসি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রয়াত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংক থেকে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবাসহ অন্যান্য ভাতাভোগীরা ভাতা গ্রহণ করে থাকে। মূলত এসব ব্যাংকে বিভিন্ন সময়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হন তারা। ব্যাংকের কোন কোন শাখায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে একদিনে ২০ থেকে ২৫ জন করে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। এ কারণে একটি শাখা সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন বন্ধ থাকলে ওই শাখায় মাত্র ৬০ থেকে ৮০ জন করে ভাতা তুলতে পারছেন। আবার কোন কোন শাখা কোন ধরনের ঘোষণা ছাড়া ভাতা প্রদান বন্ধ রেখেছে। এতে পদে পদে হয়রানির শিকার হন ভাতাভোগীরা।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের সদস্য আরমান বাবু রোমেল। তিনি লোহাগাড়া উপজেলা বিআরডিবি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীসহ ভাতাভোগীরা প্রতিনিয়ত ব্যাংকের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হুইলচেয়ার নিয়ে সিএনজি ট্যাক্সি ভাড়া করে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে ব্যাংকে গেলেও সহজে কোনো প্রতিবন্ধী ভাতা তুলতে পারে না। ব্যাংকের ম্যানেজার নেই কিংবা যিনি এটার দায়িত্বে আছেন তিনি আজকে অফিসে আসেননি, এ ধরনের নানা অজুহাত তুলে তাদের হয়রানি করা হয়। করোনা সংকটের এ সময়ে তাদের হয়রানি আরো বেড়েছে। সাধারণ ছুটির কারণে গড়ে সপ্তাহে ২ থেকে ৩দিন উপজেলাসমূহের রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো বন্ধ থাকায় অনেকে ভাতা তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাছাড়া ভাতাভোগীদের জন্য ব্যাংকে আলাদা কাউন্টার, র‌্যাম কিংবা লিফট নেই। এতে হুইল চেয়ারে বসে প্রতিবন্ধীরা ব্যাংকে যেতে পারে না।’

একই অভিযোগ করেছেন রাউজানের এক জনপ্রতিনিধি। তিনি নোয়াজিষপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরোয়ার্দ্দী সিকদার। তিনি বলেন, ‘সরকারি ভাতা নিয়ে প্রায়শঃ আমরা ভাতাভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে থাকি। কিন্তু কেন জানি এটার একটা স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য্য করে। কোনো কারণে ওইদিন ভাতাভোগীদের কেউ যেতে না পারলে পরবর্তীতে ব্যাংকের হয়রানির শিকার হন। অথচ সরকারি ভাতা নির্দিষ্ট সময়ে ভাতাভোগীর ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়। এ ক্ষেত্রে ভাতাভোগীকে তার সুবিধা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে উত্তোলনের সুবিধা দিলে এসব হয়রানি আর হতো না। বর্তমান করোনা সংকটের সময়েও তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করলে ভাতাভোগীদের সমস্যা অনেকখানি লাঘব হতো।’

তবে হয়রানির বিষয়টি মানতে নারাজ ব্যাংক ম্যানেজাররা। এমনকি তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একই সুরে কথা বলেছেন। সোনালী ব্যাংক লোহাগাড়া শাখার ম্যানেজার শ্যামল কান্তি পাল বলেন, ‘ভাতাভোগীদের হয়রানির বিষয়টি সত্য নয়। কেউ আমাকে অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

তিনি বলেন, ‘চলমান করোনা সংক্রমনের শঙ্কার কারণে ভাতাভোগীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। তারপরও প্রতিদিন নির্ধারিত ৫০ জন থেকে বাড়িয়ে আরো বেশি মানুষকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা অফিস সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে এক লাখ ৮০ হাজার ১০২ জন মাসিক ৫০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। এর মধ্যে জেলার ১৫ উপজেলায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৬০ জন এবং মহানগরে ১০ হাজার ৪২জন। সবমিলে তাদের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ১০৮ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার টাকা। একই জেলায় মাসিক ৭৫০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৫৪ হাজার ৬২ জন। এর মধ্যে ১৫ উপজেলায় ৪৩ হাজার ৬৭৫ জন এবং মহানগরে ১০ হাজার ৩৮৭ জন। তাদের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৮ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। মাসিক ৫০০ টাকা করে বিধবা ভাতা পান ৫১ হাজার ৪৩৯ জন। ভাতাভোগী সবাই চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার। মহানগরে কেউ বিধবাভাতা পান না। বিধবা ভাতার জন্য চট্টগ্রামে সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ৩০ কোটি ৮৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

ভাতা প্রদান প্রসঙ্গে জেলা সমাজসেবা অফিস চট্টগ্রাম এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি তিনমাস পরপর ভাতাভোগীরা ভাতার বহি ব্যাংকে দিয়ে সরাসরি টাকা উত্তোলন করেন। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এর বিভিন্ন শাখা হতে এই টাকা নগদ প্রদান করা হয়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সকল ব্যাংক সীমিত আকারে সামাজিক দূরত্ব মেনে ভাতার টাকা বিতরণ করে যাচ্ছেন।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিজাম উদ্দীন আহম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের এই কঠিন সময়েও অগ্রণী ব্যাংকের সব শাখাকে যথাসময়ে ভাতা প্রদানে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের হয়রানির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ভাতা পরিশোধে হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের প্রত্যেক শাখাগুলোতে যথাসময়ে ভাতা প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে শাখা প্রধানদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে করোনার কারণে সোনালী ব্যাংকের কোন শাখা দুইদিন, আবার কোন শাখা তিনদিনও বন্ধ থাকছে। এতে হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। তারপরও এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হচ্ছে।’

প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবাসহ অন্যান্য ভাতা প্রদানে আলাদা কাউন্টার থাকার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘জনবল ও অবকাঠামোগত কারণে সোনালী ব্যাংকের সবগুলো শাখায় আলাদা কাউন্টার না থাকলেও আগ্রাবাদ ও লালদিঘি শাখায় রয়েছে। এ দুইটি কাউন্টার থেকে আলাদা কাউন্টারের মাধ্যমে ভাতা প্রদান করা হয়।’

কৃষি ব্যাংক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক খালেদ হোসেন বলেন, ‘কৃষি ব্যাংকের প্রত্যেক শাখায় বর্তমানে জেনারেল লেনদেন করা হচ্ছে। এর বাইরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে সব শাখায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য যেসব ভাতা দেওয়া হয় সেসব শাখায় করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ জনের ভাতা প্রদান করতে বলে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য শাখা প্রধানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কোন শাখা যদি চায় এ সংখ্যার চেয়ে আরো বেশিজনকে প্রদান করতে তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রদান করতে পারবে।’

প্রসঙ্গত, সারাদেশে প্রায় ৮০ লক্ষ লোক বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলা ভাতা এবং অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে আসছে। তারমধ্যে বয়স্কভাতা পান ৪৪ লক্ষ লোক। জনপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে তাদের জন্য সরকারের বছরে ব্যয় হয় মোট ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। বিধবা ভাতা পান ১৭ লক্ষ লোক। জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে এ খাতে সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় মোট ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। প্রতিবন্ধী ভাতা পান ১৫ লক্ষ ৪৫ হাজার লোক। জনপ্রতি ৭৫০ টাকা করে বছরে ব্যয় হয় মোট ১৩শ’ ৯০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। ভাতাভোগীদের জন্য ব্যাংকে আলাদা কাউন্টার থাকার নিয়ম থাকলেও ব্যাংকগুলোতে এখনো সে ধরনের কোন কাউন্টার নেই। যার কারণে ভাতাভোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দৈনিক পূর্বকোণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!