খালেদ জামিল : বাড়িটা লোহাগাড়ার ঐতিহ্যবাহী চুনতিতে হলেও চাকরি ও দায়িত্বের খাতিরে থাকতে হচ্ছে লোহাগাড়ার আধুনগরে। বাসার অনতিদূরেই ডলু খাল। ডলু খাল আমার বাসা, প্রিয় প্রতিষ্ঠান আধুনগর ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা ও সাবেক প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী, সুপ্রাচীন দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন গারাঙ্গিয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার পাশ বেয়ে চলে গেছে অনেক উত্তরে, নিজ গন্তব্যে।
ডলুর সাথে আমার সম্পর্ক ও মুহাব্বত অনেক দিনের। আমার চাকরি তথা শিক্ষকতার সময়কাল যত দিন, ঠিক ততদিনের। নব্বই সাল থেকে অদ্যাবধি আছি ডলুর পাশে। নব্বই থেকে দুই হাজার এক সাল পর্যন্ত এগারো বছর আধুনগর ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসায় শিক্ষকতার সময়ে ছিলাম ডলুর পাশে।
দুই হাজার দুই সাল থেকে দুই হাজার তেরো সাল পর্যন্ত এগারো বছর গারাঙ্গিয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস পদে শিক্ষকতার সময়ে ছিলাম ডলুর পাশে। তখনকার সময়ে গারাঙ্গিয়া ডলু ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়িতে বা হেঁটে হেঁটে, অথবা ডলুর পানিতে নৌকা যোগে অথবা হাঁটু পানিতে পায়জামা ভিজিয়ে কিংবা শুষ্ক ডলুর বুক ডিঙিয়ে মাদরাসায় যাতায়াতের স্মৃতি মানসপটে জাগরুক থাকবে আমৃত্যু। আর আধুনগর ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করার পর এখন তো বসবাস করছি ডলুর প্রতিবেশী হয়ে।
বন্ধু গন ! যে ডলু খালের কথা বলছিলাম এটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি প্রসিদ্ধ খাল। ডলুর শুরু-শেষ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা-জ্ঞান না থাকলেও, অনেক বছর ধরে যা দেখে এসেছি তা হলো : ডলু ছিল অনিন্দ্য সুন্দর একটি খাল, এর তলদেশ ছিল অগভীর ও সমতল। এখানে চলত নৌকা , পাহাড়ি এলাকা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হত কাঠ ও দীর্ঘ সারি বাঁধা বাঁশের চালি। ডলুর বুকে বিরাজমান ছিল মূল্যবান বালুরাশির বিরাট মজুদ, যাতে বালু মহালের ইজারাদারদের নিয়োজিত শত শত শ্রমিক থালা নিয়ে বালু উত্তোলনে তৎপর থাকত সব সময়। পরিকল্পিত ও অনুমোদিত উপায়ে বালু উত্তোলনের ফলে ব্যহত হত না ডলুর সৌন্দর্য, বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হত না এর দুই পাড়। ডলুর পাড়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হলেও তা মেরামত করা যেত এবং করাও হত।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো , বিগত এক দশকে দেখলাম যে, ডলুর বালু উত্তোলনে প্রয়োগ করা হল ডিজিটাল সিস্টেম। বালু উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের স্থলে ডলুর বূকে বর্গী রূপে চেপে বসল অনুমোদিত – অননুমোদিত শত শত বড় ও ভারি পাম্প মেশিন। এই মেশিন গুলোর রাক্ষুসে পাইপ ডলুর বুক চুষে খেয়ে ফেলল এর রক্ত , মাংস ও অস্থি মজ্জা। ফলত এখন ডলুর অতীত রূপ-সৌন্দর্য , গতি- নাব্যতা , সুগঠন-বাহুবল ও সম্পদ -প্রাচুর্য ••• কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাতে আছে জমাট বাঁধা পানিতে ভরা অতি গভীর খাদ- খন্দক , ক্ষেত্র বিশেষে উচু নিচু মাটির স্তুপ ও ঝরা জীর্ণ, মেরামত অযোগ্য দুই পাড়।
ডলুর প্রতিবেশী হিসেবে প্রাতকালে যখন এর ক্ষত- বিক্ষত পাড় বেয়ে হাঁটাহাঁটি করি তখন সমবেদনার সুরে একে বলি: প্রিয় ডলু! তুমি কতই না মজলুম !
যদিও বা ডলুর নেই সরাসরি কথা বলার শক্তি কিন্তু তার আছে ‘ লিসানে হাল ” তথা অবস্থার অভিব্যক্তি।
ডলু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমাকে বলে :
ওহে আদমজাদা ! প্রভু আমাকে সৃষ্টি করেছেন নিরেট তোমাদের কল্যাণার্থে। আমি বর্ষায় তোমাদের অপ্রয়োজনীয় পানি গুলো পেটে নিয়ে পৌঁছে দিই সাগরে। শীত ও গ্রীষ্মে পানি সরবরাহ করি তোমাদের ক্ষেত খামারে। সামর্থ্য অনুযায়ী সুস্বাদু মাছও তোমাদের সরবরাহ করি। তোমাদের দালান কোঠা ও প্রাসাদ অট্টালিকার পরতে পরতে রয়েছে আমার অংশ। আমার অভিপ্রায় ছিল প্রভুর নির্দেশে তোমাদের খেদমত করেই যাব। কিন্তু তুমিই তো স্বীকার করেছ যে, আমি মজলুম। হ্যাঁ, তোমরা বনু আদমের হাতেই আমি বড় মজলুম।
তবে জেনে রাখো হে আদমজাদা! মজলুম সব সময় সয়েই যায় না। এক সময় সে ঘুরে দাঁড়ায়। সেই দিন আর বেশি দূরে নয় , আমিও ঘুরে দাঁড়াব।
তীব্র আঘাত হানব তোমাদের লোকালয়ে। যে আঘাতের শিকার হবে তোমাদের রাস্তাঘাট, সমাধিস্থল, উপাসনালয় , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , আবাসস্থল তথা সব কিছুই।
বন্ধু গন !
সত্য বলতে কি? অভিমানী প্রিয় ডলুর হুমকি শুনে আমি ভীত সন্ত্রস্ত। মজলুম ডলুর প্রতিশোধের ভয়ে আমি এখন তটস্থ।
লেখক : অধ্যক্ষ, আধুনগর ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।