নিউজ ডেক্স : বামনশাহী খালে একটিমাত্র বাঁধেই মরে যাওয়ার উপক্রম হালদা। যে বাঁধটির কারণে নগরীর বিশাল এলাকার শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য হালদায় গিয়ে পড়ছে। এতে নদীর রুই জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ওয়াসার সুপেয় পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিকের উত্তর–পশ্চিম কোণে বামনশাহী খালে বাধটি দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। অনন্যা আবাসিক এলাকার তৈরিকালে বাঁধটি দেওয়া হয়। বাঁধের কারণে পানি নিষ্কাষন বন্ধের পর খালের কমপক্ষে তিন কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে যায়। এরপর নগরীর বিশাল এলাকার শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য বামনশাহী, কৃষ্ণখালী, কুয়াইশ ও খন্দকিয়া খাল হয়ে হালদায় পড়ছে।
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। এটি বিশ্বে একমাত্র জোয়ার–ভাটা নদী যেখান থেকে রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। স্মরণাতীত কাল থেকে এ নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে রাউজান ও হাটহাজারীর শতশত ডিম সংগ্রহকারী। এছাড়াও নগরীর সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা। এ নদী থেকে মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে নগরীতে সরবরাহ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। আগামী জুনে মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে আরো দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের ঘোষণা দিয়েছে এ সংস্থাটি। নদী ও এর শাখা খালগুলোর পানি দিয়ে রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও মানিকছড়ি উপজেলার হাজার হাজার একর জমিতে কৃষি কাজ করে ফসল ফলায় কৃষক। এ অবস্থায় নদীর পানি দূষিত হলে হুমকিতে পড়বে মৎস্য প্রজনন, ওয়াসার সুপেয় পানি ও কৃষি কাজ।
সরেজমিনে পরিদর্শনে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় নগরীর অক্সিজেন ও কূলগাঁও এলাকার শিল্পকারখানা ও আবাসিকের বর্জ্য বামনশাহী খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়তো। ২০০৮ সালে অনন্যা আবাসিক এলাকা তৈরির সময় এটির উত্তর–পশ্চিম কোণে বাঁধ দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর কয়েক বছরের মধ্যে আবাসিকের উত্তর পাশে একটি বিশাল পাকা নালা তৈরি করে সংস্থাটি। বামনশাহী খালের বাঁধের কারণে শহরের বর্জ্য এই নালা হয়ে কুয়াইশ ও খন্দকিয়াসহ বিভিন্ন খাল হয়ে হালদায় পড়ছে।
এদিকে বামনশাহী খালে বাঁধের অপর অংশে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে যায়। ভরাটের কারণে খাল দিয়ে এখন মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে।
হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, ‘নগরীর বায়েজিদ থেকে কুলগাঁও এলাকার শিল্প কারখানা এবং আবাসিকের বর্জ্য হাটহাজারীর শিকারপুর ও মাদার্শা ইউনিয়নের সাতটি খাল দিয়ে হালদায় পড়ছে। বর্জ্যে সয়লাব শিকারপুর ইউনিয়নের কুয়াইশ, বাথুয়া, হামিদিয়া ও কৃষ্ণখালি খাল এবং মাদার্শা ইউনিয়নের খন্দকিয়া, কাটাখালি ও মাদারি খাল। এসব খাল দিয়ে প্রতিদিন টনে টনে বর্জ্য যাচ্ছে হালদায়। বর্জ্যে খালগুলোর স্বচ্ছ পানি কালো হয়ে গেছে। কালোর পানির গন্ধে খাল পাড় দিয়ে হাঁটা যাচ্ছে না। এমনকি শিকারপুর ইউনিয়নের শহীদুল্লাহ পাড়া সংলগ্ন লালাচন্দ্র বিল, মজুরিবিল, বান্ন্যা বিল, কুয়াইশ বিলসহ এখানকার ছোটবড় সকল খালও বিল দূষণের শিকার হচ্ছে। এতে শতশত একর জমির চাষাবাদ বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
হাটহাজারীর মাদার্শা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, ‘শিল্প ও আবাসিক বর্জ্যে হাটহাজারীর শিকারপুর ও মাদার্শা ইউনিয়নের সাতটি খালের পানি কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছে। এসব খালে এখন কোন মাছ পাওয়া যায় না। খালের সাথে যুক্ত পুকুরগুলোর পানিও দুষিত হয়ে গেছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ওজু–গোসল করা যায় না। পুকুর–বিলে এসব পানি ছড়ানোয় চর্মরোগেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘শহরের বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে হালদা। বিশেষ করে অক্সিজেন ও কূলগাঁও এলাকার শিল্পকারখানা ও আবাসিক বর্জ্য সরাসরি এ নদীতে পড়ছে। আগে এসব বর্জ্য বামনশাহী খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে যেতো। কিন্তু অনন্যা আবাসিক হওয়ার পর বামনশাহী খালে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। আবাসিকের পশ্চিম–উত্তর পাশের ড্রেনের সাথে বামনশাহী খালটি সংযুক্ত করে দেয় সিডিএ। এতে বামনশাহী খালের বর্জ্য আবাসিকের ড্রেনের মাধ্যমে কুয়াইশ খালে গিয়ে পড়ছে। এরপর কুয়াইশ ও খন্দকিয়া খাল হয়ে বর্জ্য পড়ছে হালদা নদীতে। অপরদিকে প্রতিবন্ধকতার কারণে বামনশাহীর খালে বিরাট অংশ ভরাট হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে বামনশাহী খালটি পুনঃসংস্কার এবং অনন্যা আবাসিকের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের পুনঃপরিবর্তন করতে হবে। অন্যথা হালদার পরিণতি বুড়িগঙ্গার মতো হবে। তাছাড়া অনন্যা আবাসিকে বসতি হওয়ার পর সেখানে বর্জ্য আরো বেড়ে যাবে। এরপর দূষণের পরিমাণ কি যে ভয়াবহ হবে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। -দৈনিক পূর্বকোণ