ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | দুর্নীতি সূচকে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ

দুর্নীতি সূচকে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ

104752Transparency-International_Horijontal

নিউজ ডেক্স : বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০১৭ অনুযায়ী ২০১৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান দুই ধাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ সামান্য অগ্রগতি বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩ এর তুলনায় এখনো অনেক কম, অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ বিশেষ করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর দুদক এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

আজ সকালে সিপিআই ২০১৭ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে ধানমন্ডিস্থ টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রকাশ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ০-১০০ স্কেলে ও অবস্থান উভয় বিবেচনায় ২০১৬ এর তুলনায় ২ ধাপ এগিয়েছে। ১০০ এর মধ্যে ৪৩ স্কোরকে গড় স্কোর হিসেবে বিবেচনায় বাংলাদেশের ২০১৭ সালের স্কোর ২৮ হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলে প্রতীয়মান হয়। তদুপরি দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে। অতএব, উল্লিখিত সামান্য অগ্রগতি কোনো অবস্থাতেই সন্তোষজনক নয়। তবে অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি কাঠামো তুলনামূলকভাবে সুদৃঢ়তর হয়েছে এই ধারণা থেকে সূচকে বাংলাদেশের স্কোর দুই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ঘাটতি, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম ও দুর্নীতি ও বিশৃংখলায় জড়িত সহায়তাকারী ও দায়ীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিচারের আওতা তথা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সফল হতে না পারায় আমরা আরো ভালো করতে পারিনি।

সিপিআই ২০১৭ অনুযায়ী ৮৯ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে নিউজিল্যান্ড। ৮৮ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, এবং তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড যাদের স্কোর ৮৫। ৯ স্কোর পেয়ে ২০১৭ সালে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া। ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিন সুদান এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে সিরিয়া। এবছর একই স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের সাথে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী সতেরতম অবস্থানে সম্মিলিতভাবে আরও রয়েছে গুয়াতেমালা, কেনিয়া, লেবানন ও মৌরিতানিয়া।

ড. জামান আরো বলেন টিআই কর্তৃক সিপিআই ২০১৭ ফলাফলে বিশ্বব্যাপী নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার সাথে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায় যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুর্নীতি মোকাবেলায় মুক্ত ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ, অবাধ গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাসহ জনগণের জন্য সহায়ক ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন অগ্রযাত্রায় কেউ বাদ না যায়। একইসাথে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কোন ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৭ সালের সিপিআই অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি আশংকাজনক। সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লক্ষণীয় উদ্যোগ গ্রহণের পরও অধিকাংশ দেশ এর প্রচেষ্ঠার ক্ষেত্রে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়েছে, দুই-তৃতীয়াংশের অধিক দেশ ৫০ এর নিচে স্কোর পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে সকল দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ (এনজিও) কম সুরক্ষা পেয়ে থাকে, সে সকল দেশে দুর্নীতি অধিকতর মাত্রায় বিদ্যমান।

এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৭ সালের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে ভুটান, যার স্কোর ৬৭ এবং উপর দিক থেকে অবস্থান ২৬। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, যার স্কোর ৪০ এবং অবস্থান ৮১। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এরপরে শ্রীলংকা ৩৮ স্কোর পেয়ে ৯১তম অবস্থানে রয়েছে। ৩৩ স্কোর পেয়ে ১১২ তম অবস্থানে এরপর রয়েছে মালদ্বীপ এবং ৩২ স্কোর পেয়ে ১১৭ তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। অন্যদিকে, ৩১ স্কোর পেয়ে ১২২তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ এর পরে ১৫ স্কোর পেয়ে সূচকে চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান।

উল্লেখ্য, সিপিআই এর ০-১০০ স্কেল এর ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়। যে দেশগুলো সূচকে অন্তর্ভুক্ত নয় তাদের সম্পর্কে এ সূচকে কোনো মন্তব্য করা হয় না। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন এমন দেশগুলোতেও কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয় যে, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবি’র গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআই-এ বিবেচিত হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতই টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। যদিও দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ- সর্বোপরি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায়, তথাপি বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি এবং তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছেনা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র  ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান। আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র উপদেষ্টা – নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। ২০১৭ সালের সিপিআই-এ ২০১৬-২০১৭ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। সূচকের তথ্য সংগ্রহে মূলত চারটি ধাপ অনুসৃত হয়। যেমন: উপাত্তের উৎস নির্বাচন, পুনঃপরিমাপ, পুনঃপরিমাপকৃত উপাত্তের সমন্বয় এবং পরিমাপের যথার্থতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। জরিপগুলোতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশ্লেষকবৃন্দের ধারণার প্রতিফলন ঘটে থাকে।

উল্লেখ্য যে, টিআই এর বার্লিনস্থ সচিবালয়ের গবেষণা বিভাগ কর্তৃক সিপিআই প্রণীত হয়ে থাকে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিসটিকস ও পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগ এবং ইতালির মিলানস্থ বকনী বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের বিশেষজ্ঞবৃন্দ কর্তৃক সিপিআই এর তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি বা মেথোডলজি প্রণীত হয়েছে। এছাড়া সিপিআই এর স্কোর জার্মানীর হার্টি স্কুল অব ইকোনমিক রিসার্চ এবং মেক্সিকোর মনটেরে ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এন্ড হায়ার এডুকেশনের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক যাচাইকৃত।

সিপিআই ২০১৭ এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট ২০১৭, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে ২০১৭, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্ ২০১৬, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স ২০১৭-১৮, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স ২০১৭-১৮, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড ২০১৭, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস ২০১৭ এবং ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডাটাসেট ২০১৭ এর রিপোর্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!