নিউজ ডেক্স : চলতি বছরের শুরুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান হাতের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলামের। এরপর তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের একজন চিকিৎসকের কাছে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওই চিকিৎসক মিনহাজকে জানান, ‘তার হাতের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, এজন্য কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন।’ কিন’ তাতে ব্যথা না সারলে আবারও ওই চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। এবার আর্থোপ্লাস্টি করাতে বলেন চিকিৎসক। কিন’ মিনহাজ সেটি না করিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে চলে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আর্থোস্কোপি করাতে বলেন।
মিনহাজ বলেন, প্রথমত ব্যথার কারণ নির্ণয় করতে সময় লেগেছে। এরপর যখন কারণ ধরা পড়ে, তখন আমাকে আর্থোস্কোপি করাতে বলেননি। কিন’ ভারতে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ‘এধরনের সমস্যায় দ্রুত আর্থোস্কোপি করাতে হয়।’ এখন আমার হাত পুরোপুরি সুস’। সেই হাত দিয়ে সবকিছু করতে পারি।
ভুল চিকিৎসা এবং ডায়াগনসিস, দুর্ব্যবহার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট, রোগীকে সময় কম দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে স’ানীয় চিকিৎসকদের প্রতি অনাস’া তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের রোগীদের। ফলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটার প্রবণতা বেড়েছে। চিকিৎসার জন্য রোগীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শুধুমাত্র ভারতে গিয়েছেন প্রায় ২০ হাজার রোগী। যা বিগত বছরের সংখ্যাকে অতিক্রম করেছে।
চট্টগ্রামস’ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছেন ১৯ হাজার ৩২৯ জন রোগী। এর আগের বছর ২৮ হাজার ৩৩৮ জন রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রতিবছর বাড়ছে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করানোর রোগীর সংখ্যা। অনেকে মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে ঘুরতে গিয়ে সেখানে চেকআপ করাচ্ছেন।
হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, অনেক রোগী আসেন ভিসার জন্য। এরমধ্যে হৃদরোগ ও ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। আমরা দেখেশুনে মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত ভিসার ব্যবস’া করে দেই।
ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব কমার্শিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকসের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রতি তিনজনের একজন বাংলাদেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে চিকিৎসা গ্রহণকারী বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশি। ওই অর্থবছর ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের এক লাখ ৪১ হাজার ২৮৭টি মেডিক্যাল ভিসা দেয়। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ৩৬০টি ভিসা নিয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণে দেশের চিকিৎসাসেবার মান বাড়ছে না। এছাড়া সেবাদাতাদের আচরণের সমস্যাও রয়েছে। এদেশের অনেক চিকিৎসক রোগীর কথা না শুনে আগে প্রেসক্রিপশন লিখে ফেলেন। ভুল চিকিৎসায় ও ডায়াগনসিসের অভিযোগ অহরহ। এসব কারণে মানুষ আস’া হারিয়ে বিদেশে ছুটছেন।
তবে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস’্যসেবার মান দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭ প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস’্য সাময়িকী ল্যানসেটের এক গবেষণায় বলা হয়, স্বাস’্যসেবার মানের দিক দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। সারা বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে স্বাস’্যসেবার মান ও সহজপ্রাপ্যতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস’ান ১৩৩তম এবং ভারতের অবস’ান ১৪৫।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে স্বাস’্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রাথমিক স্বাস’্যসেবায় বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়েও ভালো অবস’ানে রয়েছে। তবে জটিল রোগের চিকিৎসা সেবাতে ঘাটতি রয়ে গেছে বলে প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেন। এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটসহ এর কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানান তিনি। তাই দেশ থেকে রোগীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রতিবছর রোগীর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। কিন’ কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে এখনো। কিভাবে পরিসি’তি উত্তরণের সম্ভব, সেবিষয়ে কোনো কৌশল গ্রহণ করছে না কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে দেশের মন্ত্রী-এমপিরা নিয়মিত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। তাই সাধারণ মানুষের না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। আবার স্বাস’্য খাতে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে না তা কিন’ নয়। তবে ঘাটতি এখনো রয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার কারণে পয়সা খরচ করে মানুষ এখন ভালো সেবা নিতে চাচ্ছেন। সেজন্য বিদেশে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে স্বাস’্যখাতে বিদেশি বিনোয়োগ নেই। ফলে প্রতিযোগিতা কম। দেশের অন্যান্য খাত যেভাবে এগুচ্ছে, বিপরীতে স্বাস’্যখাত দিন দিন পেছাচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাস’্যখাত এগিয়ে নিতে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। এজন্য প্রথমে স্বাস’্য খাতকে অর্থনৈতিক খাত হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।
এদিকে, স্বাস’্যসেবার মান বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সেলিম মো. জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে। এখন জ্বর আসলে বিদেশে চলে যাচ্ছেন অনেকে। তবে স্বীকার করতে হবে, অনেকে দেশে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে বাইরে যাচ্ছেন। এজন্য দেশে চিকিৎসক সংকট মূলত দায়ী। একজন চিকিৎসক একশ’র বেশি রোগী দেখলে ভুল এমনে হতে পারে।
অধ্যক্ষ সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, পূর্বের চেয়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। কিন’ জটিল রোগে আক্রান্তরা এখনো বিদেশমুখী। এসব রোগীর সেবা নিশ্চিতে চিকিৎসা সেবার মান আরো বাড়াতে হবে। এজন্য কিছু মৌলিক বিষয় পরিবর্তন আনা দরকার।
তিনি বলেন, প্রথম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। এজন্য মেডিক্যাল উচ্চ শিক্ষায় ডিগ্রির ব্যবস’া এবং আগ্রহীদের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। নার্সিংয়ের জন্য ডিগ্রিধারী নার্স লাগবে। যাতে রোগীরা নার্সিং ঠিকমতো পান। রোগীর মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিতে দরকার সাইক্রিয়াটিক। যাতে রোগী দেশের চিকিৎসা সেবার ওপর আস’া রাখতে পারেন।
অধ্যাপক সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দক্ষ টেকনোলজিস্ট দরকার। আমাদের দেশে এসব লোকের অভাব রয়েছে। ভেজাল ওষুধ থেকে রক্ষা পেতে ক্লিনিকাল ফার্মাসিস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। উন্নতমানের অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। রোগীরা যাতে ভালো জায়গায় চিকিৎসা সেবা পান। হৃদরোগীকে যদি ফ্লোরে চিকিৎসা দিতে হয়, তাহলে সেই চিকিৎসার কার্যকারিতা কতটুকু সেটি সবাই বুঝতে পারেন। এছাড়া প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ছে। তাই আরো হাসপাতাল তৈরি করতে হবে।
সূত্র : দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ