Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় চট্টগ্রামের নওশাদ

বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় চট্টগ্রামের নওশাদ

নিউজ ডেক্স : ২০১৯ সালে ফলিত পদার্থ বিদ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. নওশাদ আমিন। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান। তাঁর জন্মস্থান রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা এলাকায়। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনালে কর্মরত আছেন। ফলিত পদার্থবিদ্যায় মালয়েশিয়ার শীর্ষ ১১ জন বিজ্ঞানীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ড. নওশাদ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই ১১ জনের একজন। মালয়েশিয়ার পর ফলিত পদার্থবিদ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকায়ও স্থান করে নিয়েছেন প্রবাসী এই বাংলাদেশি। বিশেষত সৌরশক্তির গবেষক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে ড. নওশাদ আমিনের।

শৈশবে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন নওশাদ আমিন। পরে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে জাপানে পাড়ি জমান তিনি। ১৪ বছর জাপানেই কাটান। সেখানে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমার পর টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি অর্জন করেন।

পরে আমেরিকার সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে ফেলোশিপ পান। স্নাতক পর্যায় (১৯৯৬) থেকেই সৌর বিদ্যুতের মূল সৌরকোষ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। ২০০৪ সালে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনালে কর্মরত আছেন তিনি। শীর্ষ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতির খবরটি নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন ড. নওশাদ।

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ড. নওশাদ আমিন সবুজ রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা গ্রামের চিকিৎসক নুরুল আমিন চৌধুরী ও দিলারা আমিনের দ্বিতীয় সন্তান। জন্ম থেকেই নগরীর নন্দনকাননে নানাবাড়িতে বেড়ে ওঠা। বাবা প্রয়াত চিকিৎসক নুরুল আমিন স্বাধীনতা উত্তরকালে কর্ণফুলী পেপার মিলের হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাথে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধের সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন।

দুই ভাইয়ের মধ্যে নওশাদ কনিষ্ঠ। বড়ভাই আরশাদ আমিন বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল থেকে ১৯৯২ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বর্তমানে কর্ণফুলী সার কারখানায় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত।

নওশাদ ভারত এবং জাপান সরকারের পূর্ণ বৃত্তি ও আমেরিকায় আংশিক টিউশন ওয়েভার লাভ করেন। তবে বাবার ইচ্ছায় জাপানের মনবুশো (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) বৃত্তি গ্রহণ করে ১৯৯০ সালের অক্টোবর থেকে ১৪ বছর জাপানে কাটান।

এরপর বছরতিনেক জাপান মটোরোলাতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাঝে বছরখানেকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে ফেলোশিপে ও গবেষণা করেন। স্নাতক পর্যায় (১৯৯৬) থেকেই সৌর বিদ্যুতের মূল সৌরকোষ বিষয়ে গবেষণা শুরু। তবে, ২০০৪ সাল থেকে নিজ সিদ্ধান্তেই ১৪ বছরের জাপানের থিতু সময়ের ইতি টেনে শিক্ষকতা পেশা নিয়ে মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ভার্সিটিতে যোগ দেন।

তবে গবেষণার পরিবেশ না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ ছিলেন। এরপর ২০০৬ সালে মালয়েশিয়ার সরকারি ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ায় সিনিয়র লেকচারার পদে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০১২ সালে প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান। মূলত এখানেই ২০০৭ থেকে শুরু। গবেষণাগার তৈরি থেকে শুরু করে সৌরকোষের গবেষণার কাজ শুরু হয় দীর্ঘ বিরতির পর।

এরপর মালয়েশিয়ার সরকার ছাড়াও সৌদি আরব, কাতার ফাউন্ডেশনের গবেষণার নানা অনুদান লাভ করে দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে নেন। গত ১০ বছরের মধ্যে তার গবেষণার কাজ চলেছে নানা প্রতিকূলতায়। এর মাঝেই তৈরি হয়েছে দক্ষতাসম্পন্ন অনেক ছাত্রছাত্রী ও অনুরাগী গবেষক।

২০১৮ সাল থেকে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনালের বিশেষ আমন্ত্রণে স্ট্রাটেজিক হাইয়ার প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। সৌরবিদ্যুতের প্রাণকেন্দ্র সৌরকোষের উপর তার গবেষণার কাজ মূলত দুই প্রকার- মৌলিক ও ফলিত। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার পাওয়ার কোম্পানির ৫০ কোটি টাকা সমমানের অনুদানে গবেষণাগার তৈরির দায়িত্ব পড়ে, যা এই মাসে শেষ হবে।

এছাড়া এ বছর আমেরিকার ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশনের যৌথ অনুদান লাভ করেন টেঙাসের প্রেইরিভিউ ‘এ অ্যান্ড এম’ ভার্সিটির সাথে এবং সৌদি আরবের কিং সাউদ ভার্সিটির সঙ্গে যৌথভাবেও গবেষণার অনুদান পেয়েছেন।

নওশাদ আমিন জানান, সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ এটমিক এনার্জির এনার্জি ইনস্টিটিউটে প্রথম প্রজন্মের সোলার সেলে গবেষণার কাজে ২০১১ সাল থেকে যতদূর পেরেছেন সহায়তা করে গেছেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুদান ‘হেক্যাপ’ লাভে মুখ্য ভূমিকা রেখে পরে প্রধান পরামর্শক হিসেবে গবেষণাগার তৈরি ও সৌরকোষ গবেষণার কাজে সহায়তা করে যাচ্ছেন। এছাড়া সায়েন্স ল্যাবরেটরির জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রে দ্বিতীয় প্রজন্মের সৌরকোষ গবেষণার উদ্যোগ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করে আন্তর্জাতিকমানের গবেষণাগার স্থাপনায় পরামর্শক ও প্রাথমিক প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন।

নওশাদ আমিন বলেন, গবেষণা বিষয়ে ১০-১৫ বছর আগেও বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। নেতৃত্বের সদিচ্ছার কারণে মালয়েশিয়া আজ অনেক এগিয়ে গেছে।

সৌরশক্তির সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি ও নেতিবাচক প্রচারের কারণে সৌরশক্তি তার সম্ভাবনাময় গ্রহণযোগ্যতা দেখতে পারছে না। বিশ্বে এ পর্যন্ত ৬শ গিগাওয়াটের সৌরশক্তির স্থাপনা হয়েছে, যা সহজ ভাষায় ৪৫০টিরও অধিক এক গিগাওয়াট (১ এড) মানের পারমাণবিক চুল্লিকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম।

সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতার সাথেই সোলার প্যানেল সারা বিশ্বের কোনো না কোনো জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে, যার মূলে থাকবে সৌর কোষ/প্যানেল, বাংলাদেশ সরকারের সে রকমই পরিকল্পনা। দুর্বল আমদানি ও পরীক্ষণ নীতিমালার কারণে উচ্ছিষ্টমানের সৌর প্যানেল আমদানি করে ইতোমধ্যে জনমনে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ১৯৪৬ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে ৬ শতাংশ সূর্যালোক থেকে বিদ্যুতে রূপান্তর ক্ষমতার সৌরকোষ আবিষ্কৃত হওয়ার পরে নানা পদার্থের সৌরকোষে গবেষণা চলে আসছে। ৪৫ শতাংশের উপরেও রূপান্তর ক্ষমতার সৌরকোষ আছে, যা মহাকাশ যানে বা স্যাটেলাইটে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭০ সালে অয়েল শক অধ্যায়ের পর জাপান উদ্যোগ নেয় সৌরকোষকে বিদ্যুতের কাজে লাগানোর। তাতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বাসাবাড়িতে ব্যবহার হয়ে এসেছিল।

তিনি বলেন, টেকনাফে ২০ মেগাওয়াটের সোলার ফার্ম গ্রিডে সংযুক্তি পাবে। আমি মনে করি, গ্রিড কানেক্টেড সোলার ফার্মকে আরো উৎসাহিত করা যাবে। তাঁর মতে, বাসাবাড়ির ছাদে ‘রুফটপ সোলার’ ফার্ম বাধ্যতামূলক করে তা পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। নতুবা দুর্নীতির কারণে সোলার গার্বেজের সংখ্যা বাড়বে।

নওশাদ বলেন, শিক্ষা-গবেষণা ও বাণিজ্যিক প্রসারে আমরা দুর্বল নীতিমালায় আক্রান্ত। তাঁর মতে, দেশে বানিয়ে খরচ কমানোর চিন্তা ত্যাগ করে প্রচুর গবেষক তৈরি করে আপাতত দেশে-বিদেশে তাদের মেধাকে পেটেন্ট, পেপারের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি তাঁর পরামর্শ, মেধা অর্জনে ও বিকাশে কাজ করে যাও। মেধার সঙ্গে প্রচেষ্টা থাকলে এক সময় না এক সময় সাফল্য আসবেই।

বর্তমানে মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ার পাশে বাঙ্গি শহরে থাকেন ড. নওশাদ। সাথে আছেন মা দিলারা আমিন, স্ত্রী জান্নাতুল ওয়াসুল ও তিন কন্যা নুসাইবা, যাহরা ও আয়েশা। দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!