মনে পড়ে

411

শীলা ঘটক : অনেকদিন আগের কথা বলছি, প্রায় ১৯৭৪/৭৫ হবে, আমি (শুভ) তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বন্ধু রবি, সজল, সুদীপ এরা আমার সহপাঠী। সুদীপ আমাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়। হঠাৎ একদিন সুদীপ এসে বলল, তোরা নাটক দেখতে যাবি? রামদা পাশ দিয়েছে, টিকিট কাটতে হবে না। উত্তর কোলকাতার কোন একটা থিয়েটার হলে চলছে ‘বিপ্লবী মাস্টারদা’ আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে বললাম, যাবো যাবো—- তখন নাটক দেখা বা নাটক করার খুব প্রবণতা ছিল আমাদের মধ্যে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই চলত নাটকের রিহার্সাল…… ঘর থেকে তক্তাপোষ বের করে স্টেজ করা হোতো। আর মা, কাকিমাদের কাপড় দিয়ে ঘিরে মঞ্চ তৈরি করা হোতো। দর্শক বলতে আমাদের পরিবারগুলো, এছাড়া পাড়ার আরও যারা বাসিন্দা তারা। সে কি উৎসাহ! নাওয়াখাওয়ার সময় নেই, সারাদিন রিহার্সাল। তারপর নির্দিষ্ট একটা দিন দেখে মঞ্চস্থ হোতো সেই নাটক। আমাদের এইসব দেখে পাড়ার কাকুরা খুব উৎসাহ দিতেন, বলতেন—ছেলেগুলো এইসব নিয়ে থাকে , খুব ভালো গুন। কখনো ‘বালক বিলে’ কখনো ‘রামের সুমতি’ আরও কত পালা। মেয়েদের চরিত্রে আমার বোন শিউলি, সুদীপের বোন প্রতিমা আর আমাদের সবার আদরের খেঁদি পিসি। যে কোন কারনেই হোক খেঁদি পিসির বিয়ে হয়নি। উনি আমাদের সকলের গৃহশিক্ষিকা ছিলেন। এই পিসিও আমাদের নাটকের একজন কুশীলব।

আমরা সকলে মিলে নাটক দেখতে যাবো খুব আনন্দ। তখনকার দিনে টালিগঞ্জ থেকে উত্তর কোলকাতায় যেতে অনেকটা সময় লাগতো, বেরিয়ে পড়লাম আমরা। সে কি আনন্দ! বলে বোঝানো যাবে না। আগেই বলেছি সুদীপ আমাদের মধ্যে একটু বড়, গায়ে এবং বুদ্ধিতেও বেশ জোর আমাদের থেকে।যথা সময়ে হলে পৌঁছালাম। ততক্ষণে নাটক শুরু হয়ে গেছে… হল অন্ধকার, ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না আমাদের সিট, কোন মতে ধাক্কাধাক্কি করে ঢোকার চেষ্টা করলাম, একদম শেষ প্রান্তে আমাদের বসার সিট। ঢোকার সময় সামনে বসা একটি ছেলে পায়ের ওপর আমার পায়ের চাপ লেগে গেলো, ব্যস আর দেখে কে, লেগে গেলো ঝামেলা। কথা কাটাকাটি, তোমরা দেখতে পাও না? পা মাড়িয়ে দিয়ে ঢুকচ্ছ? আমি বললাম দেখতে পাইনি। আমাদের মধ্যে সজল খুব রগচটা ধরণের। কথাটা শুনেই বলে, একটু চাপা পড়েছে তো কি হয়েছে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে নাকি? আমি কাউকেই থামাতে পারিনা। চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঝগড়া। আমাদের সামনের এবং আমাদের পেছনে যারা বসে নাটক দেখছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে বললেন, এই তোমরা চুপ করবে?…… কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। যাইহোক আমরা চুপ করে গেলাম। যাদের সঙ্গে ঝগড়া লেগেছিল তারা আমাদের থেকে বয়সে একটু বড়, ওদের মধ্যে কেউ একজন বলল, নাটকটা শেষ হতে দে, তারপর দেখাচ্ছি মজা। হল থেকে বের হোক একবার, এমন পিটান পিটাবো না, চুপচাপ থাক। কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর ধক্‌ করে উঠলো, মনে মনে ভাবলাম যদি আমাদের ধরে মারে তাহলে তো আমরা গেলাম! কি করি! মন দিয়ে নাটকটাও দেখতে পারছিলাম না। কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম, মাস্টারদার সেই সাহসী অভিনয়! আহা মনে দাগ কেটে গেল। নাটক শেষের দিকে…… প্রায় নাটক অন্তিম পর্যায়ে, আমার বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো! শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পর্দা টেনে দিল। আমি পড়ি কি মরি গ্রিনরুমের দিকে ছুটলাম, আমাকে ছুটতে দেখে সুদীপ বলে, ওই কই যাস তুই? কোন উত্তর না দিয়ে ছুটলাম…….হাঁপাতে হাঁপাতে গ্রিনরুমের পাশ দিয়ে এক্কেবারে স্টেজে গিয়ে হাজির হলাম। সবাই কথা বলতে ব্যস্ত। আমি খুঁজছি মাস্টারদাকে। মাস্টারদাকে আমার খুব প্রয়োজন। সবাই আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল ……দেখি স্টেজের এক পাশে একটা টুলের ওপর বসে মাস্টারদা খুব আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছেন। মনে মনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম, যাক তাহলে মাস্টারদা কে পেয়ে গেছি। আস্তে আস্তে ওনার কাছে গিয়ে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে উনি একটু সোজা হয়ে বসে বললেন, কি চাই? বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বললাম, কতগুলো ছেলে আমাদের মারবে বলছে, হল থেকে বের হলেই পেটাবে, আপনি আমাদের বাঁচান…… আমার কথা শুনে উনি বললেন, আমি কি করবো? তুমি কে? আমি শুধু একটাই কথা বলতে রইলাম আমাদের বাঁচান, আপনি তো অনেক সাহসী! শুনে উনি কিছুটা ইতস্তত হয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, আমি তো মাস্টারদা নই, আমি তো অভিনয় করি। শুনে হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে…… কি বলবো ভেবে পেলাম না…… স্টেজে এতক্ষণ যাকে দেখলাম আর এখন যাকে দেখছি …… একেবারে বিপরীত চরিত্র!

মাথা নীচু করে স্টেজ থেকে নেমে এলাম। ওরা তিনজন হলের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, আমাকে দেখে সুদীপ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো…… বললে, কি রে কোথায় গেছিলি? আমরা কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। রাত হয়ে গেছে বাড়ি যেতে হবে তো…… চল। আমি এদিকওদিক তাকিয়ে বললাম, ওই ছেলেগুলো? সুদীপ বলল, ধুস্‌ ওরা এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে। চল চল বাড়ি চল।

লেখক : শীলা ঘটক, কোচবিহার, কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!