ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | ভয়ঙ্কর নেশা ফেসবুক : হতাশা আর অন্ধকার জগতের হাতছানি

ভয়ঙ্কর নেশা ফেসবুক : হতাশা আর অন্ধকার জগতের হাতছানি

5sx3wN_1537376821

নিউজ ডেক্স : বাস্তববাদী জীবন থেকে পরাবাস্তব জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম নামের ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো আর হোয়াটসআপের নেশা। প্রায় সকল বয়সী, বিশেষ করে তরুণদের মন ও মগজে সারাদিন- সারারাত ঘুরপাক খাচ্ছে ইন্টারনেটের অবাধ দুনিয়া।

এক ছাদের নিচে পাশাপাশি বসবাস করেও পরিবারের কারো সঙ্গে কারো কোন কথা নেই। মোবাইলের স্ক্রিনে তীক্ষè নজরেই চলে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের সামনে বসে আত্মচর্চায় ব্যস্ত থাকছেন সকলেই।

সামাজিক যোগাযোগ রক্ষায় মাধ্যমটি যতোটা না সহায়তা করছে তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে অসামাজিক হতে। যতই দিন যাচ্ছে গভীর এমন মনযোগের বস্তুটি নীতি- নৈতিকতাহীন ও এক মুমূর্ষু জাতি গঠনের পাল্লাকেই কেবল ভারি করছে। যেখানে কোনো স্বপ্ন নেই, নেই পৃথিবী গড়ার মন্ত্র। আছে কেবল হতাশা আর অন্ধকার জগতের হাতছানি।

চলমান এই পরিস্থিতিকে সমাজের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে উল্লেখ করে সমাজসংস্কারক আর বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, অনেক হয়েছে, এবার রাস টেনে ধরা দরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নামের এই খেলা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বড় ধরণের বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এখনই একেবারেই বন্ধ করে দেয়া না গেলেও অন্তত রাত ১২টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত এই ছয় ঘণ্টা অন্তত বন্ধ রাখা হোক ফেসবুকসহ সকল যোগাযোগ মাধ্যম। এই সময়টাতেই অনাচার হয় বেশি। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা : ইন্টারনেট লাইভ স্ট্যাটসের হিসেবে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটি ১০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ। এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাংলাদেশে কতজন ফেসবুক ব্যবহার করে, সেটির কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত-সংশ্লিষ্টদের হিসেবে, বাংলাদেশ থেকে দেড় থেকে পৌণে দুই কোটি ফেসবুক একাউন্টধারী রয়েছেন। নিয়মানুযায়ী ১৩ বছরের নিচের কেউ ফেসবুকে একাউন্ট খুলতে পারে না। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৪০০ জিবিপিএস (গিগা বিটস প্রতি সেকেন্ড) ইন্টারনেট ব্যান্ডউইটথ ব্যবহার হয়। তবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোট ইন্টারনেট ডেটার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহারে খরচ হয়। সে হিসাবে মোট ইন্টারনেট ব্যান্ডউইটথের ১০০ জিবিপিএস ব্যবহার হয় ফেসবুকের মাধ্যমে। তাই দিনে ছয় ঘণ্টা করে ফেসবুক বন্ধ থাকলে ইন্টারনেট ব্যবহারে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

কোকেনের চেয়েও ভয়ংকর ফেসবুক আসক্তি : ‘সাইকোলজিক্যাল রিপোর্টস : ডিসএবিলিটি এন্ড ট্রমা’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, ফেসবুক ফিড নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে মস্তিষ্কে যে অনুভূতি হয়, কোকেন ঠিক একই ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে।

ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক প্রফেসর অফটির টুরেল বলেন, যারা ফেসবুকে প্রবেশ না করে থাকতে পারেন না তাদের মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার অংশে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। কোকেন নিলে মস্তিষ্কের ঠিক একই অংশে প্রায় একই ধরনের কর্মকা- চলে।

গবেষণায় শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্নের তালিকা দেওয়া হয়। সেখানেই তারা ফেসবুকের প্রতি আসক্তির কথা স্বীকার করেন। এ সময় তাদের বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়। বলা হয়, তাদের পছন্দের ছবি প্রদর্শনমাত্র একটি বাটনে চাপ দিতে বলা হয়। দেখা গেছে ফেসবুকের ছবি দেখামাত্র কয়েকজন ওই বাটনে চাপ দিয়েছেন। এরা আগে থেকেই ফেসবুকে আসক্ত। গবেষকরা দেখেছেন, মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশকে উত্তেজিত করে ফেসবুক। এই অংশ ঘটনা, আবেগ ইত্যাদির গুরুত্ব তুলে ধরে।
কয়েকজন অংশগ্রহণকারী ফেসবুকে ছবি দেখে এত দ্রুত ক্রিয়াশীল হয়েছেন যা রাস্তায় চলাচলের সময় নির্দেশক চিহ্ন দেখেও হন না। এজন্য বিষয়টিকে ভয়ঙ্কর বলে অভিহিত করেছেন গবেষকরা। কারণ রাস্তায় চলাচলের সময় নির্দেশক চিহ্ন না দেখে মোবাইলে ফেসবুকের নোটিফিকেশন দেখতে থাকলে তা দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

এদিকে লাইভ সায়েন্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকে আসক্তরা যেন মাদকাসক্ত। ফেসবুকে অবস্থানের সময় এমনভাবেই কাজ করেন তারা। তবে গবেষকদের দাবি এ ধরনের আচরণ চিকিৎসার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে ফেসবুকে আসক্তি তাড়ানো সম্ভব। ফেসবুকের মতো টুইটার ব্যবহারকারীরাও একই ধরনের আসক্তিতে শিকার।

কমছে মনোযোগ : ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেন, ‘আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়াই তারা সবাই একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। গত কয়েক বছর থেকে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসছে। অনেক সময়েই মনে হয় পড়ানোর সময় আমি যেটা বলছি ছাত্রছাত্রীরা সেটা শুনছে, কিন্তু বোঝার জন্যে মস্তিষ্কটি ব্যবহার করতে তাদের ভেতর এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের আলস্য। আমার মনে হয়, এটি হচ্ছে ফেসবুক জাতীয় সামাজিক নেটওয়ার্কে বাড়াবাড়ি আসক্তির ফল। এটি নিশ্চয়ই শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, সারা পৃথিবীর সমস্যা। আমি একাধিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দেখেছি, মাদকে আসক্তি এবং ফেসবুকে আসক্তির মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।’

এই শিক্ষাবিদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ২০১৫ সালে মাইক্রোসফট পরিচালিত এক সমীক্ষায়। দেখা গেছে, স্মার্টফোন-বিপ্লব ঘটার আগে মানুষের মনোযোগের স্প্যান ছিল ১২ সেকেন্ড। এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র আট সেকেন্ডে। আর সবচেয়ে কম মনোযোগের খেতাবধারী গোল্ডফিশের স্প্যান ৯ সেকেন্ড ! কাজেই সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে কপাল চাপড়ানোর আগেই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা।

ফেসবুক নিয়ে সরকারের পর্যবেক্ষণ : গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারের ফলে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটছে। এতে সামগ্রিকভাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে। কার্টুন চ্যানেলগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার ফলে শিশুরা গভীর রাত পর্যন্ত কার্টুন দেখছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় এতে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণের তাগিদ প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের : মধ্যরাতে ফেসবুক ও কার্টুন চ্যানেল বন্ধ রাখার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৬ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে। তখন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশ দেন। এরপর এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মতামত চেয়ে গত আগস্টেই একটি চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু সাত মাসে এ বিষয়ে কোনো জবাব না পাওয়ায় ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে আরেক দফা চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মতামত চেয়ে ৩ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বিটিআরসিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিটি পাঠায়। চিঠিতে বিটিআরসির মতামতে বলা হয়, বর্তমানে ফেসবুক শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটি ব্যবহার করে সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে নারীরা অনলাইনে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করেন। কারিগরিভাবে কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফেসবুক বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে বয়স নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই। ফেসবুক ইন্টারনেট গেটওয়ে থেকে বন্ধ করা হলেও বিভিন্ন ভিপিএন বা প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে ব্যবহার করা সম্ভব। বিটিআরসি আরও বলেছে, ফেসবুক বন্ধ করলেও ভাইবার, হোয়াটসএপের মতো মাধ্যম দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকায় যোগাযোগ করার জন্য মধ্যরাত বেশি সুবিধাজনক।

বিটিআরসি’র ওই চিঠিতে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পরামর্শও দেয়া হয়। এর মধ্যে ছিল- ছাত্রছাত্রীদের ফেসবুকসহ ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগে অভিভাবকের মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। এছাড়া স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে কী দেখছে, সে বিষয়ে অভিভাবক, গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির পরামর্শও দেয়া হয়।

এদিকে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফেসবুক বন্ধের দাবিতে সরব হয়েছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ। যুব সমাজকে রক্ষার স্বার্থে রাত ১১টার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করছে ছেলে-মেয়েরা। এরা রাতে না ঘুমিয়ে জেগে জেগে ফেসবুক দেখে। তাই ফেসবুককে একটি সময়সীমার মধ্যে আনলে ভালো হয়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই ফেসবুক নেই। চীনে নেই, সৌদি আরবে নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাইলে যুবক- তরুণদের রক্ষা করতে হবে উল্লেখ করে রওশন এরশাদ বলেন, যেভাবেই হোক ফেসবুকের আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে।

ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ মতামত : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, যে কারণে ফেসবুক বন্ধ করার চিন্তা করা হচ্ছে, সেটি হাস্যকর। ফেসবুকের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে, সন্তানের প্রতি অভিভাবকের খেয়াল রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার এমনিতে কমে আসবে।

সূত্র : দৈনিক পূর্বকোণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!