ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | বাড়ছে কিশোর অপরাধ, অভিভাবকরা চিন্তিত

বাড়ছে কিশোর অপরাধ, অভিভাবকরা চিন্তিত

নিউজ ডেক্স : যে কিশোরদের ওপর ভর করে একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের চিন্তা করা হচ্ছে, যারা বড় হয়ে একসময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে, সেই কিশোররাই আজ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, হত্যা, ছিনতাই সংঘর্ষসহ নানান ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় তাদের অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও বেড়ে চলেছে কিশোর অপরাধের মাত্রা।  

জেলায় গত এক বছরে নানান অপরাধের দায়ে মামলা হয়েছে ৪১ জন কিশোর-কিশোরীর বিরুদ্ধে। এ সব মামলায় অনেকে পলাতক থাকলেও অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীরা জামিনে রয়েছে। আবার অনেককেই পাঠানো হয়েছে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অভাবের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, মাদকের কালোছায়া, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, ভার্চ্যুয়াল জগতের নেশায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার কারণেই এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

তাদের মতে কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে বড় ভাই নামক গ্যাং লিডাররা অনেকটা দায়ী। এসব বড় ভাইয়েরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে কিশোরদের ব্যবহার করছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। উঠতি বয়সের এসব তরুণ হঠাৎ ক্ষমতার সংস্পর্শে এসে অনেকটা বেপোরোয়া হয়ে ওঠে।

জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত এক বছরে জেলায় হত্যা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ ৪১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় ১১টি, কসবা থানায় সাতটি, নবীনগর থানায় পাঁচটি, নাসিরনগর থানায় দুইটি, সরাইল থানায় সাতটি, বিজয়নগর থানায় সাতটি ও আখাউড়া থানায় দুইটি। এসব অপরাধে ৩১ জন কিশোর জামিনে আছে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে ছয় জন।  

এদের মধ্যে একজন কিশোর রায়হান (১৫)। ২০২০ সালের ২৫ শে মার্চ বুধবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মৈন্দ গ্রামে তিন বছরের এক শিশুকে ১০ টাকার লোভ দেখিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় ওই শিশুর মা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।  

এদিকে একই উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের মীরহাটি গ্রামে ১৪ বছর বয়সের কিশোর সুমন প্রতিবেশী আট বছরের এক শিশুকে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরে এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ তাকে আটক করে আদালতে হাজির করলে আদালত তাকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠায়। বর্তমানে সে জামিনে রয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই দুই কিশোরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

অপর এক কিশোরী তানিয়া (১৫)। পারিবারিক কলহের জেরে খুন করে নিজ মাকে। গেল ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর নিজ ঘরেই বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে মাকে। ঘটনার শুরুতে বিষয়টি আত্মহত্যা মনে হলেও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে কিশোরীর হাতে মায়ের হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর বিষয়টি।

এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ধর্মজিৎ সিংহের সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ওই কিশোরী বর্তমানে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে। মূলত ছেলে হারানো মায়ের মানসিক ভারসাম্যহীন আচরণে বিরক্ত হয়েই তানিয়া তার মাকে হত্যা করে।

জেলা শহরের দাতিয়ারা এলাকার বাসিন্দা মোমেনুর রহমান। গত ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে শহর থেকে বাসায় যাওয়ার সময় তিন জন কিশোর ছেলে তাকে রাস্তায় আটক করে। পরে ধারালো চাকুর ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় চিৎকার দিলে র‍্যাবের টহল গাড়ি এসে পড়ায় তাদের আটক করে ফেলে। তাদের কাছ থেকে চাকু ও সীমবিহীন মোবাইলসহ নগদ ৩৮ হাজার ৩০০ টাকা জব্দ করে। পরে সদর মডেল থানার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় মোমেনুর রহমান সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

একাধিক অভিভাবক জানান, যে হারে কিশোর অপরাধ বাড়ছে তা মূলত সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে সন্তানরা যখন বাড়ির বাহিরে যায় মনের ভেতরে তখন একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে। কারণ কিশোররা অপরিণত বয়সের হওয়ায় যেকোনো প্রলোভনে কিছু না বুঝেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এক শ্রেণীর মানুষ এসব কোমলমতি কিশোরদের দিয়ে বিভিন্ন অন্যায় কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। এতে করে কিশোররা অনেকটা অজান্তে অন্ধকার জগতে চলে যায়। কিশোর অপরাধ প্রতিহত করতে হলে- প্রথমে কিশোর অপরাধ কেন হচ্ছে? কারা এর জন্য দায়ী তা খুঁজে বের করতে হবে। এবং প্রকৃত দায়ীদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা গেলে কিশোর অপরাধ কমে আসবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিশু নাট্যমের সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ মোহাম্মদ খান বিটু বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই। তাদের ব্যবহার করছে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও মাদক ব্যবসায়ী। উঠতি বয়সের কিশোরদের দিয়ে কৌশলে মাদক বিক্রি করাচ্ছে। বিভিন্ন পাড়া মহল্লার বড় ভাইদের দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছে তারা। তাদের তালিকা তৈরি করে নজরদারিতে আনা উচিত।

সচেতন নাগরিক কমিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহ-সভাপতি আব্দুন নূর বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার ও স্মার্টফোন এখন কিশোর কিশোরীদের বিপথগামী হওয়ার একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিকভাবে তেমন একটা নজরদারি করা হচ্ছে না। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ক্রিয়া ক্লাব ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নাই। ফলে সব কিশোর- কিশোরীরা মোবাইলের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কিশোর অপরাধের তিনটি দিক রয়েছে সামাজিক, মনস্তাত্তিক ও আইনগত। এ ঘটনাগুলো বাড়ার পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো লক্ষ্য করা যায় তা হল কিশোর অপরাধের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। আইনের যে বিধান রয়েছে তা সঠিক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছে তাড়া দায়িত্ব পালন করছে না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এইসব কিশোরদের মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে অনুপ্রাণিত করছে। এ সব সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেলাধুলার চর্চা বাড়িয়ে তোলা, সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কাজে কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করা যায় তাহলে তারা বিপৎগামীতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করি।  

জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রইছ উদ্দিন বলেন, কিশোররা যদি অপরাধে জড়িয়ে যায় সমাজের বড় একটা অংশ অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। আমরা কিশোর অপরাধগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক এলাকার অপরাধী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।  

তিনি আরো বলেন, আইনের পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন বাড়িয়ে সবাই সম্মিলিত চেষ্টা চালালে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব।  বাংলানিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!