আবু বকর মুহাম্মদ হানযালা: মানবমন শুদ্ধির প্রক্রিয়ায় রমদান। আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, আত্মতুষ্টি, আত্মসমর্পণ ও আত্ম উন্নয়নের মাস রমদান। রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত সমন্বিত রূপই রমদান। এ’মাস আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে মুসলমানদের জন্য অফুরান নেয়ামাহ। প্রাণ উচ্ছ্বাসে, প্রাণোচ্ছল, ধর্মীয় গাম্ভীর্য রীতি,সংস্কৃতি ও আবেগে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা পবিত্র রমদান মাসে রোজা পালন করে থাকেন। এটি আল্লাহ তা’আলার আরোপিত ফরজ বিধান। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,হে ঈমানদারগণ!তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর,যেনতোমরা মুত্তাকী হতে পার।-সূরা বাকারা (২) : ১৮৩। আরো বলেন,
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে”।- সূরা বাকারা (২) : ১৮৫।
রোজা পালন ও পালনকারীর প্রতিদানও অনন্য। প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে বান্দার জন্য আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট হয়ে যাবেন। পবিত্র হাদীস শরীফে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন ;আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, বান্দা একমাত্র আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে, রোযা আমার জন্যই, আমি নিজেই তার পুরস্কার দিব আর (অন্যান্য) নেক আমলের বিনিময় হচ্ছে তার দশগুণ।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮৯৪;। কুরআন ও সুন্নাহ’র দৃষ্টিভঙ্গিতে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার গুরুত্বও অপরিসীম। ১৪০০ বছর আগে মুসলিম সমাজে রোজা রাখার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল,যা বর্তমান আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব বিশ্বে একই সঙ্গে বিজ্ঞাননির্ভর, স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসিক প্রশান্তির আধার। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ও ইতিবাচকভাবে জীবনদর্শনেও রোজার কার্যকরী ভূমিকা অনন্য। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে রোজা স্মরণশক্তি বাড়ায়, মনঃসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত করে। প্রীতি,ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্বিক শক্তির উন্মেষ ঘটায়। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বৃদ্ধিতে অনন্য সহায়ক। পয়েন্টেভিত্তিক রমদানের সাথে বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর সমন্বয় বিষয়াদি উল্লেখ করার প্রয়াস করছি;

১) মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল: বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়াড মনে করেন, রোজা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। কারণ, রোজা শারীরিক সক্ষমতা তৈরির পাশাপাশি এনে দেয় মানসিক প্রশান্তিও।
২) জীবনীশক্তি দান ও আত্মহত্যার প্রতিরোধক: ডা. আইজাক জেনিংস বলেছেন, যারা আলস্য ও গোঁড়ামির কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনীশক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা করে।
৩) খিচুনি ও মানসিক অস্থিরতার প্রতিরোধক।
৪) কিডনির সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়।
৫) অতিরিক্ত মেদ হ্রাস: ডা. গোলাম মোয়াজ্জেম কর্তৃক ‘মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধ অনুযায়ী জানা যায়, রোজায় শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে, তবে তা শরীরের কোন ক্ষতি করে না বরং শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর।
৬) ক্ষতিকারক টক্সিনের মাত্রা নির্মূল :
৭) বাত রোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ,হৃদরোগ ও রক্তচাপের নিরাময়ক: পাকিস্তানের প্রবীন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, যারা নিয়মিত সিয়াম পালন করে সাধারণত তারা বাতরোগে, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যধিতে আক্রান্ত কম হয়।
৮) মৃগারোগ,গ্যাষ্ট্রিক ও আলসারের প্রতিষেধক : জার্মানির ডাক্তার ফেডারিক হভম্যান বলেছেন, রোজার মাধ্যমে মৃগীরোগ, গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়।
৯) পাকস্থলী রোগের আরোগ্য : ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ ক্যাব্রিজের ডাক্তার লেখার জিম, তিনি রোজাদার ব্যক্তির খালি পেটের খাদ্য নালীর লালা, স্টোমাক সিক্রেশন সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন, রোজার মাধ্যমে ফুডপার্টিকেলস বিহীন পাকস্থলি দেহের সুস্থতার বাহন। বিশেষত পাকস্থলীর রোগের আরোগ্য গ্যারান্টি।
১০) কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সহায়ক :
গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা মানবদেহের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমিয়ে নিয়ে আসে এবং ভালো (উপকারী) কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়। আর এর মাধ্যমে মানুষের হার্টকে কার্ডিওভাসকুলার রোগ থেকে রক্ষা করে।।
১১) রক্ত পরিশোধিত হয়: আধুনিক গবেষণা বলছে,
আমাদের রক্তে নানা রকম বর্জ্য পদার্থ এবং ক্ষতিকর পদার্থ ঘুরে বেড়ায়। এই রক্তকে পরিশোধন করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে রোজা।
১২) টাইপ টু ডায়বেটিস রোধে সহায়ক : টাইপ টু ডায়াবেটিসের মূল কারণ হচ্ছে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। সম্প্রতি দুটো গবেষণা বলছে, টাইপ টু ডায়াবেটিস রিভার্স করতে চাইলে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ২৪ ঘণ্টার ফাস্টিং করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার ফাস্টিং কেউ যদি সপ্তাহে তিন দিন করেন, তবে তিনি টাইপ টু ডায়াবেটিস নিরাময় করতে সক্ষম হবেন। সেই সময় তার স্থূলতাও তার শরীর থেকে চলে যাবে।
১৩) দীর্ঘায়ু জীবন দান: আধুনিক বিজ্ঞান বলছে,
মাঝে মাঝে রোজা, উপবাস বা ফাস্টিং একজন মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে তাকে দীর্ঘজীবী করে।
১৪) চর্মরোগের প্রতিরোধক: বিজ্ঞান বলছে, শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। কায়রো থেকে প্রকাশিত ‘Science Calls for Fasting’ গ্রন্থে দ্রষ্টব্য,পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, “The power and endurance of the body under fasting conditions are remarkable : After a fast properly taken the body is literally born afresh.” অর্থাৎ রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য : সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।
১৫) ইউরিক অ্যাসিডের প্রতিরোধক।
এছাড়াও, আধুনিক বিজ্ঞানে রোজার প্রতি চেতনা সৃষ্টি করার পেছনে বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদের মতে, মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরে কতিপয় দিন উপবাসের অভ্যাস গড়ে তোলা। তাদের মতে, উপবাস খাবারের উপাদান থেকে সারা বছর শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি দান করে। শরীরের জমে থাকা বিষগুলো রমজানে নির্গত হয়, যা ধ্বংস না হলে শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, একজিমা, পেটের পীড়া ইত্যাদি রোগ জন্ম নেয়। উপবাসে কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
১৬) পেপটিক আলসারের প্রতিষেধক।
শরীর -মনের উৎফুল্লতা, সতেজতায় আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক। আসুন, রবের সন্তুষ্টি, জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধির নিমিত্তে একনিষ্ঠতায় রোজা পালনের চেষ্টা করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের তৌফিক দান করুন। আ-মীন।
লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মুঠোফোন : 01829910500