নিউজ ডেক্স : সর্বশেষ ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়। এরপর অবসরের বয়স বাড়ানো হলেও প্রবেশের বয়স আর বাড়েনি। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, সেশনজট, নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। তবে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি সরকার।
এমনই প্রেক্ষাপটে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার দাবিতে জোরদার আন্দোলনে যাচ্ছে সংগঠনগুলো। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে ৩২ বছর।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য কয়েক দফা সুপারিশ করা হয়। গত সরকারের শেষ সময়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি হারিয়ে যায়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স বাড়ানোর কোনো চিন্তা সরকারের নেই।
আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে সবকিছুর মতো তাদের আন্দোলনেও স্থবিরতা নেমে ছিল। গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রেস ক্লাবে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে ফের আন্দোলন শুরু করেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ। পরিষদের নেতারা জানান, শিগগিরই তারা দাবি আদায়ে দেশব্যাপী জোরদার আন্দোলনের ডাক দেবেন।
একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর আর অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিক থেকে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ২৭ বছর আর অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০-এ উন্নীত করা হয়। ২০১২ সালে দুই বছর বাড়িয়ে অবসরের বয়স ৫৯ বছর করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়স করা হয় ৬০ বছর।
গত ডিসেম্বরে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা সংস্থা- বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ (৩৩ দশমিক ১৯ শতাংশ) পুরোপুরি বেকার৷
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ কর্মহীন ও চাকরিহীন হয়েছেন। একইসঙ্গে কমেছে চাকরির সার্কুলার ও আবেদনের হার। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে অনলাইনে চাকরির সার্কুলারের হার কমেছে ৮৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি চাকরির সার্কুলার কমেছে পোশাক ও শিক্ষা খাতে। সার্কুলার কমলেও খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে এনজিও।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর আন্দোলন করছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ। পরিষদের সভাপতি সোনিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বড় একটি সমস্যা হলো সেশনজট। লেখাপড়া শেষ করতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী মোটামুটি চার বছরের সেশনজটে পড়েন। যেখানে ২৪ বছর বয়সে মাস্টার্স শেষ করার কথা, সেখানে ২৮ বছর লেগে যায়। থাকে আর দুই বছর। দুই বছর পরই আমাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৭ বছর অর্থ, শ্রম ও সময় দিয়ে লেখাপড়ার দুই বছর পর আমার শিক্ষাগত সনদ ইনভ্যালিড হয়ে যায়। ৩০ বছর পার হওয়ার পর লেখাপড়া শিখেও আমি একজন অশিক্ষিত মানুষের মতো হয়ে যাই সরকারের কাছে। শিক্ষাই জতির মেরুদণ্ড কিন্তু শিক্ষিত হয়ে ৩০ বছর পর আমি মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাচ্ছি।’
‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেশনজট নেই, এটা ভুল কথা। এখনও সেশনজটের জন্য সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন।’
পাশের কোনো দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর নেই— দাবি করে সোনিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ভারতে করোনাকালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৮ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা হয়েছে। করোনার কারণে বাড়ানো হলেও এটা স্থায়ীভাবেই করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে বলছেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করা হলে বেকার সমস্যা আরও বাড়বে। যখন ২৭ থেকে ৩০ করা হয়েছিল তখন কি সমস্যা হয়েছিল? বয়সসীমা বাড়ানো হলে, সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলেও ২/১ বছর পর তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে কমপক্ষে ৩৫ করার দাবি জানিয়ে পরিষদের সভাপতি বলেন, দেশে ৩০ লাখ বেকার রয়েছে। আমরা দাবি আদায়ে অহিংস আন্দোলন করে আসছি। মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, মশাল মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, রিকশা মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামীতে আমরা জোরদার আন্দোলনে যাব।’
‘পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করে সময় বেধে দেব। দাবি পূরণ না হলে ৬৪ জেলায় আন্দোলনের ডাক দেব। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করেই যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য দশম জাতীয় সংসদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তিন-তিনবার সুপারিশ করে। আমরা মনে করি, আমলাদের অনাগ্রহের কারণে চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি আটকে আছে।’
ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খান রাসেল বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির জন্য আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি একটু বিঘ্নিত হচ্ছে। শিগগিরই আমরা বড় ধরনের আন্দোলনে যাব।’
তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনা করলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছরের দাবিটি খুবই যৌক্তিক। সরকারি চাকরির সার্কুলার দেয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চাকরিতে প্রবেশে প্রায় ৩/৪ বছর লেগে যায়। সবাই কমপক্ষে চার বছরের সেশনজটে পড়েন। আমি এক বছরের মাস্টার্স ২৬ মাসে শেষ করেছি। চার বছরের অনার্স করেছি পৌনে সাত বছরে। পৃথিবীর কোনো দেশেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছরের কম নয়। আমাদের তো গড় আয়ু বেড়েছে।’
‘কিন্তু সরকার আমাদের দাবি কানেই তুলছে না। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি বলে মনে হয় যৌক্তিক দাবি আমলে নিচ্ছে না’ বলেন খান রাসেল।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর কোনো চিন্তা সরকারের নেই। প্রধানমন্ত্রী একেবারে ডাটা ধরে বলেছেন, ৩০ বছরের বয়সী যারা বিসিএস দেয়, এক শতাংশেরও নিচে তারা চান্স পায়।’
‘তবে কোভিডের কারণে ছাড়পত্র নেয়ার পরও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি কোনো কোনো সরকারি দফতর। এর মধ্যে অনেকের বয়সও ৩০ পেরিয়ে গেছে। তাই আমরা বলেছি, ২৫ মার্চ যাদের বয়স ৩০ ছিল, নতুন (আগেই ছাড় দেয়া) বিজ্ঞপ্তি যখনই প্রকাশিত হবে তখন তারাও আবেদন করতে পারবেন। বয়সের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে’ বলেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন। আমরা ব্যাখ্যা দিয়েছি, ২৩ থেকে ২৪ বছরে মাস্টার্স পাস হয়ে যায়। সে মিনিমান ছয় বছর সময় পায় (চাকরি নেয়ার জন্য)। কোভিডের আগে কোনো জায়গাতেই কোনো সেশনজট ছিল না।’
২০১৮ সালের ২০ আগস্ট তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি সরকার ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। এন্ট্রিটা (চাকরিতে প্রবেশের বয়স) বাড়তে পারে, আশা করছি। খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবেন।’
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা পুনর্বিন্যাসের সময় এসেছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি মনে করেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ কিংবা ৪০ বছর করা যেতে পারে। এছাড়া অবসরের বয়সও ৬৫ করা যেতে পারে। জাগো নিউজ