ব্রেকিং নিউজ
Home | সাহিত্য পাতা | মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৫)

মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৫)

432

শীলা ঘটক : ‘বল শুনি, বলবি বলেছিস কিন্তু’। আকাশ লিখতে থাকে।
‘রিউ দে গ্রেনাস এর একটা বাড়িভাড়া করে রকি থাকতো, বিয়ের পর ওখানেই আমাকে নিয়ে যায়। খুব সুন্দর ওখানকার বাড়িগুলো, দেখার মতো!’
‘রিউ দে গ্রেনাস টা কি?’ আকাশ জানতে চায়।
‘ আরে ওটা হোল জেনেভা শহরের একটা এলাকা, বিয়ের পর আমরা ওখানে থাকতাম’।
‘থাকতাম মানে? এখন তাহলে তুই কোথায় আছিস? রকির সাথে থাকিস তো?’
তিতির অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
‘কি রে, চুপ করে আছিস কেন?’ আকাশ প্রশ্ন করেই যায়। তিতির তাও চুপ করে থাকে।
‘বলবি নাতো? তাহলে আমি অফ হলাম, বলতে হবেনা তোকে’।
সঙ্গে সঙ্গে লেখা ফুটে উঠলো, কোথা থেকে শুরু করবো ভাবছিলাম’।
‘বেশী ভাবতে হবেনা, যা মনে আসছে লিখে যা’।
তিতির লিখতে থাকে……
‘আমাকে এখানে নিয়ে আসার পর আমাদের দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল জানিস। দিনরাত কিভাবে কেটে যেত বুঝতে পারিনি। বেশ কয়েক মাস এইভাবে কেটে গেল। রকি মাঝে মাঝে রাতে ডিউটি করতো, আমি তখন ঘরে একাই থাকতাম’।
‘একা থাকতে ভয় পেতিস না? তুই তো খুব ভীতু!’ (হাসির স্টিকার)।
‘না না এখানে কোন ভয় নেই। এই রাতের ডিউটি ক্রমশঃ বেড়ে চলল। প্রায় রাতেই আমাকে একা থাকতে হত। এটা আমার একদম ভালো লাগতো না। মনখারাপ করতো। কোলকাতার জন্য, বাড়ির জন্য, তোদের সবার জন্য। মনে হোল এ কোথায় এলাম আমি!’
‘রকির একটা পিক দে তো দেখি, তোর বরকে কেমন দেখতে’।
‘ দেখাচ্ছি, কিন্তু তোর বর, এই কথাটা বলবি না’।
আকাশ বুঝতে পারে তিতির ভালো নেই, এমন কিছু হয়েছে যা হয়তো ও বলতে পারছে না। ইনবক্সে একটা ছবি ফুটে ওঠে। সুদর্শন পুরুষ, একবারে সাহেব সাহেব দেখতে।
‘রকি তো বেশ সুন্দর দেখতে রে। বলা যেতে পারে তোর থেকেও সুন্দর। হা হা হা’
‘হাসিস না, সব শোন আগে’।
আচ্ছা বেশ বল, শুনছি’।
একদিন আমি ঘুমাচ্ছি, তখন ছিল জুলাই মাস। জুন, জুলাই মাসে ঠাণ্ডা কম থাকে।এখানে তখন গরমকাল, একদিন এক সন্ধ্যায় ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে আমার চোখ জুড়ে এসেছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। এমন সময় বেশ কয়েকবার কলিং বেল বেজে উঠলো। প্রথমে আমি শুনতে পাইনি। তারপর দেখি বার বার বাজচ্ছে। তখন সন্ধ্যে সাতটা হবে।
দরজা খুলতেই দেখি একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে আসতে অনুরোধ করি। মেয়েটি ভেতরে এসে সোফায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বসে আমার কাছে জল চাইলো খাবার জন্য। জল দিলাম খেতে। আমি বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটি কে? কি প্রয়োজনে এসেছে। আমার থেকে বেশ কিছুটা বড়। রকি আমার চেয়ে সাত বছরের বড়, ইলিয়ানা আর রকি সমবয়সী হবে। মেয়েটি দেখতেও বেশ সুন্দরী। খুব সুন্দর ইংলিশ বলে। ওকে ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। তারপর যা বলেছিল, সবটাই তোকে লিখে দিলাম।

‘ আমি ইলিয়ানা, ইলিয়ানা মার্কেলো । প্রায় দশ বছরের বেশী আমি এখানে আছি। একসময় কাজের জন্য এখানে এসেছিলাম। আমাদের বাড়ি গোয়া তে। এখানে আসার কিছু বছর পর রকির সাথে আমার আলাপ হয়। তারপর আমাদের মধ্যে প্রেম গড়ে ওঠে। খুব ভালবাসি আমি রকিকে। আমরা একসাথে থাকতাম ইউনিভার্সিটি দে জেনেভার কাছাকাছি একটা বাড়িতে। আমি এখানকার রেডিও তে চাকরি করি। সম্পর্কের কথা আমাদের বাড়ির সবাই জানে। আমার বাবা, মা ওকে বার বার বিয়ের কথা বলেছে, আমি কতবার বলেছি এবার আমাদের বিয়ে করে ফেলা উচিৎ। কিন্তু রকি রাজি হয়না। সপ্তাহের শেষে আমরা বেড়াতে যেতাম এই শহরের বিভিন্ন দিকে। রকি কে আমি খুব ভালবাসি। গতবছর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ি, মনে মনে খুব আনন্দ পেলাম যে এবার আমরা বিয়ে করে নেবো।

রকিকে জানাতে রকি বলল, এই বেবিটা আমাদের রাখাটা ঠিক হবেনা, শুনে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম! রকি বলল, আগে আমরা বিয়ে করি তারপর……

‘শুনে আমি বললাম, চলো আমরা আজই চার্চে গিয়ে ফাদারকে সব জানাবো, আর বিয়ের দিন ঠিক করে আসবো। শুনে রকি বলল, আমি হিন্দু, আমাদের বিয়ে হিন্দুমতে হবে, চার্চে গিয়ে আমি বিয়ে করবো না। আর একটা কথা আমি বাবা, মাকে এখনো তোমার কথা কিছু বলিনি। মা, বাবার সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম! ও এখনো আমার কথা ওর মা বাবাকে বলেনি!’
‘ইলিয়ানার কথাগুলো শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল! কি বলছে এসব! ও কি সত্যিকথা বলছে?! কিন্তু মেয়েটা যেভাবে কাঁদছিল অবিশ্বাস করার কিছু নেই। হতভম্ব হয়ে গেলাম! কি করবো, কোথায় যাবো আমি! মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম মেঝেতে, জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। তারপর কি হয়েছিল আমার মনে নেই। অনেক রাতে ঘুম ভাঙতে দেখি রকি পাশে শুয়ে আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। রাগে, দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম, কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না,ওর হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে রইলাম। কাঁদতে কাঁদতে আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
অনেক ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। পর্দা সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিক তখনো অন্ধকার, যেমন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে আমার জীবন, ইলিয়ানার জীবন! ঘরের বাইরে আর ভেতরের অন্ধকার যেন একাকার হয়ে গেল। কিন্তু আমার যে অনেক কথা জানা এখনো বাকি রয়ে গেল! ইলিয়ানা কি আবার আসবে আমার কাছে?’

আকাশ একমনে পড়ে যাচ্ছিল তিতিরের লেখাগুলো, চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো, লেখাগুলো দেখা যাচ্ছে না আর, মন চাইছেনা আর একবার পড়ে। মোবাইল বন্ধ করে অর্ধশায়িত হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। চিন্তায় তলিয়ে যাচ্ছে, স্নায়ু শিথিল হয়ে আসছে। কি বলছে তিতির এইসব! ইনবক্সের কথাগুলো আকাশের কাছে দুঃস্বপ্ন মনে হতে লাগলো।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!