ব্রেকিং নিউজ
Home | উন্মুক্ত পাতা | মন ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা

মন ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা

পথেই ইফতারের পর পানি পান করছেন এই পুলিশ সদস্য। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নাওয়া খাওয়া হয় না অনেক পুলিশ সদস্যরই। ছবি: সংগৃহীত

মো. রায়হান ইবনে রহমান : ২৫ মার্চ অফিসের কাজ করছিলাম। হঠাৎ কুন্দারহাট হাইওয়ে থানার ওসি ফোন করলেন ভোগা বটতলা নামক স্থানে একটি ট্রাক রাস্তা থেকে নিচে পড়ে গেছে। মালের উপরে থাকা অনেক যাত্রী ট্রাকের নিচে পড়ে আছে দ্রুত আসেন। আমি তাৎক্ষণিক এ সংবাদ এসপি হাইওয়ে বগুড়া স্যারকে জানাই এবং ঘটনাস্থলে রওনা হই।

যেতে যেতে আমার মায়ের মত বড় বোনের ফোন, বোন আমাকে বলেন, তারা সবাই ঢাকা চলে যাচ্ছেন। কিছুদুর যাওয়ার পর মনটা কেমন যেন করে উঠলো। আমি ফোন দিয়ে বড় বোনের সাথে কথা বললাম এবং জানত চাইলাম তারা এখন কোথায়? বলল, আমরা জিয়া মেডিকেল কলেজ বগুড়ার সামনে। সেই সময় আমিও একই স্থানে।

আল্লাহর বিশেষ রহমত সেখানেই আমার বোন ভাগনে এবং দুলাভাইয়ের সাথে দেখা হল। দুলাভাইয়ের হাঁপানি রোগ ছিল সেই জন্য তার ছেলে ডাক্তার তাদের নিয়ে ঢাকার বাসায় রওনা হয়েছে। অল্প সময় তাদের সাথে থেকে আমি ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হলাম। সেখানে রাস্তার যানজট নিরসন, মৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার , আহতদের হাসপাতালে প্রেরণ করা ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে হাটিকুমরুল থানার ওসি সাহেব জানান করোনার কারণে দেশময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে মানুষের ঢল হওয়ায় যমুনা ব্রিজ, হাটিকুমরুল ও চান্দাইকোনা এলাকায় দীর্ঘ গাড়ির যানজট।

আপনারা জানেন হাটিকুমরুল হল ২২ টি জেলার প্রবেশদ্বার। যানবাহনের দীর্ঘ সারি- আমি ফোনে এসপি স্যারকে জানালে উনি বলেন, আপনি রওনা হয়ে যান আমিও আসছি। আমি হাটিকুমরুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। খাওয়া-দাওয়া না করে অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে হাটিকুমরুল মোড়ে আসি।

অনেক কষ্টের পরে যানজটের মূল কারণ উদঘাটন করি। প্রথমেই ঢাকা থেকে আসা গাড়িগুলো পরিষ্কার করি, কারণ যমুনা ব্রিজ যেন বন্ধ না হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এসপি স্যার আমার কাছে চলে আসেন, করোনার জন্য সারাদেশে সাধারণ ছুটির কারণে দীর্ঘ যানজট।

হাটিকুমরুল মোড়ে একজন এসআই রেখে আমি এরিস্টোক্রেট ব্রিজের সামনে দাঁড়ায়। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বিভিন্ন জেলার গাড়িগুলোকে লাইনআপ করি। আমি আর এসপি স্যার দুজনে মিলে সারারাত নিদ্রাহীন থেকে রাস্তার যানজট নিরসন কাজে নিয়োজিত থাকি। দুপুরের না খাওয়া, রাত্রির না খাওয়া ও নিদ্রাহীন রাত্রির পরে, আমি সকাল দশটার দিকে স্যারকে বলি আপনি কন্ট্রোল রুমে বসেন।

সেখান থেকে আমাদের দিক নির্দেশনা দেন। স্যার চলে যাওয়ার পর, কয়েকজন লোক আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তাদের দেখে মনে হয় সকলেই ড্রাইভার। তারা আসতেই, আমি বিনয়ের সহিত বলি ভাই আপনাদের এই কষ্টের জন্য আমি দুঃখিত। বললাম ভাই আপনারা তো দেখছেন আমরা কত কষ্ট করছি। আপনারা সহজে আপনাদের স্বজনের কাছে যেতে পারেন সেই জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা।
তাদের মধ্যে একজন ড্রাইভার নাম রুবেল। তিনি বললেন স্যার , এমন কথা বলে আমাদের লজ্জা দিবেন না। যানজট তখন অনেকটা সহনীয় হয়ে গেছে। আমি তাদের তাড়াতাড়ি বিদায় করার চেষ্টা করছি। রুবেল বললেন, স্যার পুলিশ আমি পছন্দ করি না। পুলিশ সম্বন্ধে আমার অনেক খারাপ ধারণা। আপনাকে দেখে আমার সেই ধারনা পাল্টে গেল। একজন মানুষ কি করে এতটা কষ্ট করতে পারে। আমি বললাম ভাই, আমি তো আমার দায়িত্বটুকু করেছি মাত্র। তিনি বললেন, স্যার আপনার পিছনের মাইক্রোবাসটা দেখছেন, আমি তার চালক। আমি সারারাত ধরে আপনাকে দেখেছি নিদ্রাহীন খাওয়া-দাওয়া হীন ও করোনার ভয়কে জয় করে এই ধরনের ডিউটি, আমার পুলিশ সম্বন্ধে ধারণা পাল্টে গেছে।
তার গলাটা যেন একটু থেমে থেমে যাচ্ছিলো, তিনি বললেন, স্যার সকল হোটেল বন্ধ। আমি অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছি আপনি যদি আমার মাইক্রোবাসে বসে এই নাস্তা টুকু খান আমি শান্তি পাব। আমিও একটু ইতস্তত করতে লাগলাম মনটা অনেক কিছু ভাবতে লাগলো। আবার কান্না কন্ঠে বলল স্যার ভয়ের কিছু নাই, আমার ভালোবাসা , আমার অনেক কষ্টে অর্জিত টাকায় কেনা নাস্তা। কাজের মাঝে ভুলে থাকা ক্ষুধা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল, আমি সব ভুলে পাগলের মতো সবকিছু সাবাড় করে ফেললাম। তিনি শুধুই আমার দিকে চেয়ে থেকে ক্ষুধার্তকে খাওয়ানোর আনন্দটা উপভোগ করলেন।

খাওয়ার পর মনে হল রাজ্যের সকল ঘুম আমার চোখে নেমে আসছে, পকেট থেকে ১০০ টাকার একটি নোট বের করে তাকে দিতেই, কেঁদে ফেললেন। আমার আর সাহস হলো না টাকাটি নেওয়ার জন্য চাপ দিতে। যাওয়ার সময় রুবেল টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে তার মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

যাওয়ার সময় আমি তাকে বললাম ভাই, আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে যান। তাকে বললাম সামনে কোথাও যানজট দেখলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দেবেন। আমি সেখানের রাস্তাটা পরিষ্কার করে দেব। ৩৩ বছর চাকরি করে ইউএন মিশন বার, আইজিপি ব্যাচ বার পাওয়াসহ অনেক প্রশংসা পেয়েছি। একজন চালকের কাছ থেকে নিজের কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। জনগণের জন্য ছোট্ট একটি কাজ মানুষকে এত বেশি আনন্দ দিতে পারে, তৃপ্তি দিতে পারে, সেই উপলব্ধি আমার হলো। সকল কিছু ছাপিয়ে হতদরিদ্র চালক রুবেলের কথা মনে করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, ইতিমধ্যে রুবেল ফোন করে জানালো রাস্তায় এখন আর কোনো যানজট নাই। স্যার আপনি বাসায় যান।
আমার বারবার মনে হতে লাগল এই সকল মানুষের ভালোবাসার কথা, সেই থেকে সবসময় আমার মনে হয়, সকল গরীব মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। আমার একটি জীবনের বিনিময়ে যদি একটি মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি, তবে সেই মৃত্যুই আমার কাম্য।

মানুষের কল্যাণে মৃত্যুবরণ অনেক অনেক বেশি শান্তির। করোনা ভাইরাস তুমি ফিরে যাও, যে দেশে রুবেলের মতো মানুষ বাস করে, সেখানে তোমাদের পরাজয় হবে। কখন যে আমি সবাইকে বিদায় জানিয়ে হাটিকুমরুল ছেড়ে বগুড়া চলে এসেছি বুঝে উঠতে পারেনি।

গাড়ি থেকে নামতে দেখি দুচোখ আমার ভিজে আছে, টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে চার তলায় আমার বাসায় পৌছায়। রুমে এসে বিছানায় শুতে যাব এমন সময় রুবেলের ফোন, স্যার বাসায় পৌঁছেছেন? আমি বললাম রুবেল তোমার ভালোবাসা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়, কিন্তু সে কষ্ট আমার আনন্দের। তুমি ভালো থাকো, তোমার কোন প্রয়োজনে আমায় কল করো।

সে বারবার বলতে থাকে স্যার ঢাকা আসলে আমাদের একটু দেখে যাবেন, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার এত আনন্দ এত শান্তির, দীর্ঘ কষ্টের মাঝে আমার এই উপলব্ধি। বাংলাদেশ পুলিশ তোমাকে স্যালুট। *লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, বগুড়া হাইওয়ে সার্কেল, বগুড়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!