নিউজ ডেক্স : অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নসহ ১৪ কারণে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। এ দূষণের ফলে শুধু নদীটির অস্তিত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে না। বরং জলজ জীব, নাগরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক জনজীবন ও দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। কর্ণফুলী রক্ষায় প্রণীত ১০ বছর মেয়াদী ‘মাস্টার প্ল্যান’ বা মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনায় এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে সরকার কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে উঠা চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে তৈরি করে আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। কিন্তু কর্ণফুলী দূষণের প্রভাবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলেও শংকা প্রকাশ করা হয়েছে মাস্টার প্ল্যানে।
প্রসঙ্গত, কর্ণফুলী নদীর দৈর্ঘ্য ২৭৫ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ৬৬৭ মিটার। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে আজ থেকে প্রায় ২৫-৩০ লক্ষ বছর আগে। সে অনুসারে কাছাকাছি সময়ে জন্ম কর্ণফুলীর। গত ১২ জুলাই কর্ণফুলী নদী রক্ষায় প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ জুন অনুষ্ঠিত একনেক সভায় কর্ণফুলী নদী এবং ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ ও দখল রোধ এবং নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ডিসেম্বরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালককে (প্রশাসন) সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের মার্চে মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালককে (প্রশাসন) সদস্যসচিব করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করে।
কর্ণফুলী দূষণের প্রভাবগুলো : মহাপরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, দূষণের ফলে নদীর বাস্তুসংস্থান ব্যাহত হওয়ায় কর্ণফুলীকে ঘিরে ‘একুয়াট্যুরিজম শিল্প’ গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ‘ওয়াটার ফ্রন্ট ডেভলাপমেন্ট’র মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহকে পর্যটন স্থানে রুপান্তরিত করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। শংকা প্রকাশ করে মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ‘দূষণ বৃদ্ধি পেলে নদী তার জীববৈচিত্র্য হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়বে। নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাবে বন্দরে আগমনকারী বিভিন্ন বৈদেশিক জাহাজসমূহের ক্রুদের কাছে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করবে। যা ভবিষ্যতে কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে চলমান আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বহির্বিশ্বের নৌযান পরিচালনকারী সংস্থাসমূহকে নিরুৎসাহিত করবে।
কর্ণফুলী নদী দূষণের ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ছে নদী তীরবর্তী জনসাধারণের উপর। ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের ‘লিডস ইউনিভার্সিটি’ পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, শিল্পজাত পানির মাধ্যমে নদী দূষণের ফলে চর্মরোগ, ডায়রিয়া এবং ডিসেন্ট্রি ছাড়াও ২০টি রোগের প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি হয়। নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের মাঝে এর প্রকোপ অধিকতর এবং এ ধারা গত ১০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য এলাকার তুলনায় নদী তীরবর্তী জনসাধারণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তিনগুণের বেশি।
দূষণের ফলে নদী তীবরর্তী এলাকায় বাসকারী জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনেও চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য তাদের প্রায়শই একই জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। এতে সামাজিকভাবে তারা আত্মীয়স্বজন হতেও অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। এমনকি নদী তীরবর্তী বায়ুদূষণ প্রবণ এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কও করতে অনীহা প্রকাশ করে।
নদী দূষণের প্রভাব পড়ছে জলজ প্রাণীর উপরও। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, একসময় কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬, মিশ্র পানির ৫৯ এবং সামুদ্রিক ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে মিঠাপানির ২০-২৫ প্রজাতি ও মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়া নদীটিতে একসময় প্রচুর শুশুক দেখা গেলেও বর্তমানে দেখা যায় না বললেই চলে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিশোধিত তরল ও কঠিন বর্জ্য নদীর পানিতে মেশার কারণে ‘ব্যাকটেরিয়া’ কর্তৃক জলজ প্রাণীর ‘ডিকম্পোজিশন/ ডাইজেশসনে’ প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এতে পনির ‘ডিও’ (ডিসলভড অক্সিজেন’ এর মাত্রা হ্রাস পায়। ফলে জলজ প্রাণীর অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়।
১৪ কারণে কর্ণফুলী নদী দূষণ : কর্ণফুলী নদী দূষণের কারণ হিসেবে মাস্টার প্ল্যানে যে ১৪ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় কোন সুয়ারেজের ব্যবস্থাপনা না থাকা, নাগরিক বর্জ্য, সাগরের বর্জ্য, অপচনশীল বর্জ্য, অপরিকল্পিত পাহাড় কাটা ও নিচু ভূমি ভরাট, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শহরে অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প, কাপ্তাই লেকের নাব্যতা হ্রাস, কর্ণফুলী পেপার মিল, নৌ-যানে এসটিপি (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) এর অপ্রতুলতা, ফিটনেসবিহীন নৌ-যান এবং নদী ও খাল সংলগ্ন অস্থায়ী বাজার।
তথ্য অনুযায়ী, শহরে ৫০ হাজার সেনেটারি এবং ২৪ হাজার ল্যাট্রিন রয়েছে যা সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে উন্মুক্ত। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরে কোন প্রকার সুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, দোকানপাট, বাজার-ঘাট, শপিং-মল, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক, হোটেল ও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সুয়ারেজ বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। শহরের ২০টি খাল ও ড্রেন হয়ে এসব বর্জ্য যাচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামের ১১ উপজেলার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর খামারসমূহের অধিকাংশে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নেই। এসব খামারের বর্জ্যগুলোও পড়ছে নদীতে।
নগরে দৈনিক আড়াই হাজার টন গৃহস্থলী ও মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শফিকুল মান্নান ছিদ্দিকী দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, তারা ৯৫ শতাংশ অপসারণ করে। বাকিগুলো খাল-নালায় মিশে।’ এদিকে চসিকের বক্তব্য সত্য ধরে নিলেও দৈনিক ৫ শতাংশ বা ১২৫ টন বর্জ্য খাল-নালায় পড়ে। এবং তার বেশিরভাগই যায় কর্ণফুলী নদীতে। কিন্তু বাস্তবে, এ পরিমাণ বেশিই হবে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন শহরের কঠিন বর্জ্য হালিশহর ও আরিফিন নগর এলাকায় উন্মুক্ত স্থানে ডাম্পিং করে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদীর পানিতে মিশছে।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে ভারী লাইটার জাহাজ বা তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে পানিতে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি তেল নির্গত হয়। যা নদীকে দূষণ করছে। নদীর উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়া তেলের আস্তরণ জমে থাকায় পানিতে অক্সিজেন মিশতে বাধা প্রদান করছে। ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এছাড়া কর্ণফুলী নদী ব্যবহারকারী নৌ-যানসমূহকে প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নিক্ষেপ করে নদীতে। সাগরে চলাচলরত নৌ-যানগুলো এসটিপি না চালিয়ে যাবতীয় বর্জ্য ফেলে সাগরে। যা জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে প্রবেশ করছে নদীতে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীতে দৈনিক ছোট-বড় মিলিয়ে ৩ হাজার নৌ-যান চলাচল করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে ব্যবহৃত ৪৪৩টি লাইটারেজ জাহাজ কর্ণফুলীতে চলাচল করে। বিপুল সংখ্যক নৌ-যানগুলোর অভ্যন্তরে এসটিপি নাই। ফলে নৌ-যানগুলোর বর্জ্য সরাসরি নদীতে নিষ্কশিত হচ্ছে।
এদিকে কর্ণফুলীর দুইপাড় ও আশেপাশে ৭০০ ছোটবড় কলকারখানা আছে। এগুলোর বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব কারখানার প্রায় ৬২ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে। পেপার মিল আর রেয়ন মিল থেকে প্রতি বছর ৩ হাজার কেজি পারদ ঢালা হচ্ছে কর্ণফুলীতে। শিল্পকারখানায় ইটিপি চালু না রাখার কারণেই এ দূষণ। তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের ৮৪টি তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী প্রতিষ্ঠান বা কল-কারখানা আছে। বেশিরভাগ সময়ে তারা ইটিপি চালু রাখে না। শহরের ৮টি পয়েন্ট বা খাল দিয়ে কারখানাগুলোর বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশ গুপ্তা বলেন, কর্ণফুলী নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এক্ষেত্রে তরল বর্জ্য নিঃসরণকারী যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর ছাড়পত্র নবায়নের সময় টেস্ট রিপোর্ট দেখা হয়। প্রতিষ্ঠানভেদে বছরে দুই বা চারবার এ টেস্ট করতে হয়। এছাড়া ইটিপির যথাযথ ব্যবহার করছে কী না সেটি নিশ্চিতে নিয়মিত মনিটরিং করি। এক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে ক্ষতিপূরণ আদায় করি। কর্ণফুলী নদীর পানির মানমাত্রাও নিয়মিত মনিটরিং করে থাকি। -দৈনিক আজাদী