নিউজ ডেক্স : ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশের হোটেল, বার ও ক্লাবগুলোতে প্রতি মাসে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়। এই মদের বড় অংশই আসে চোরাপথে। উচ্চ শুল্ক হওয়ায় মদ চোরাচালান লাভজনক ব্যবসা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের একাধিক সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকার মদ চোরাচালানের সাথে জড়িত। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজনও এই সিন্ডিকেটে সক্রিয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গার্মেন্টস পণ্যের আড়ালে প্রায় ৮০ কোটি টাকার বিদেশি মদ ধরা পড়ার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নানা তথ্য উদঘাটন করেছে। একেকটি চালানে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীসহ সারা দেশে হোটেল, বার ও অভিজাত ক্লাবগুলোতে বিদেশি মদের জমজমাট ব্যবসা চলে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মদ বিক্রি হলেও দেশের শুল্ক অফিসগুলোতে সেই অনুপাতে মদ আমদানির পরিমাণ নগন্য। চট্টগ্রাম কাস্টমসের মাধ্যমে মদ আমদানির কয়েক মাসের হিসাব দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ঘোষণা দিয়ে মাসে ২০ কোটি টাকার মদও আমদানি করা হয় না। মদের প্রায় পুরো যোগান দেয়া হয় অবৈধ পথে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি মদ কন্টেনারে করে সমুদ্রপথে আনা হয়। মদের এসব কন্টেনার দুবাই থেকে সিঙ্গাপুর, কলম্বো কিংবা পোর্ট কেলাং হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। মিথ্যা ঘোষণায় আনা মদের চালানগুলো কৌশলে খালাস করা হয় বন্দর থেকে। মদ চোরাচালানিদের পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমসের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা এসব সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। বন্দর থেকে খালাসের পর অবৈধ চালানগুলো নানা ঘাট ঘুরে পৌঁছে যায় বৈধ বারে।
জানা যায়, দেশের অভিজাত হোটেল, বার ও ক্লাবগুলোতে বৈধভাবে মদ বিক্রি হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বৈধভাবে মদ আমদানিরও অনুমতি রয়েছে। বিভিন্ন সময় নিজেদের চাহিদার কথা উল্লেখ করে এরা মদ আমদানি করে। তবে যে পরিমাণ মদ বিক্রি করে তার সামান্য অংশ আমদানি করা হয়। ওই আমদানির প্রমাণপত্র দেখিয়ে কয়েকশ গুণ বেশি মদ বিক্রি করা হয়। বাড়তি মদের পুরোটা আসে চোরাচালানের মাধ্যমে। মদ আমদানিতে সর্বনিম্ন ৬শ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮শ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। ইউরোপে ১ হাজার টাকায় কেনা এক বোতল মদের দাম শুল্ক পরিশোধ করার পর হয় ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। ১ হাজার টাকার মদ আমদানি করতে ৬ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সরকারকে এই রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করে কোটি কোটি টাকার মদ দেশে আনা হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেলগুলো ১শ বোতল মদ আমদানি করার কাগজ রেখে দু-চার হাজার বোতল মদ বিক্রি করে। এসব দেখভালের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও আছে নানা অভিযোগ। প্রতিটি হোটেল, বার ও ক্লাব থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করা হয় বলেও অভিযোগ।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে গার্মেন্টস পণ্যের ঘোষণা দিয়ে ৪০ ফুটি ৫টি কন্টেনার (১০ টিইইউএস) মদের চালান আনা হয়। এর মধ্যে দুটি ৪০ ফুটি কন্টেনার বন্দর থেকে খালাস করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জের কাছে চালান দুটি আটক করা হয়। পরে আরো তিনটি ৪০ ফুটি কন্টেনার বন্দরের অভ্যন্তরে ধরা পড়ে। এর মধ্যে তিনটি চালানের সিঅ্যান্ডএফ ছিলেন জাফর আহমদ। শেষোক্ত দুটি চালানের বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কে দায়িত্ব পালন করত তা জানা যায়নি।
তবে সবগুলো চালানের মাঝে সামঞ্জস্য রয়েছে। সবগুলো চালানই দেশের বিভিন্ন ইপিজেডে অবস্থিত বিভিন্ন কারখানার নামে আমদানি করা হয়েছে। উক্ত পাঁচটি কন্টেনারে মোট ৭৮ হাজার ৩২১ লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ পাওয়া গেছে। যেগুলোর বাজার দর কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসেবে মদগুলোর আমদানিমূল্য ৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এগুলোর শুল্ক ৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম কাস্টমসের এই হিসেবের চেয়ে মদগুলোর বাজারমূল্য অনেক বেশি জানিয়ে সূত্র বলেছে, বাজারে এক লিটার ব্ল্যাক লেভেল ব্র্যান্ডের মদের একটি বোতল ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং গোল্ড ও ব্লু লেভেলের বোতল ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল বলেন, প্রতি মাসে কম-বেশি মদের চালান আনা হচ্ছে। শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সংঘবদ্ধ চক্র মদ আমদানি ও বাজারজাত করে।
এদিকে ঢাকায় র্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে মদ চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পিতা-পুত্র চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন আব্দুল আহাদ (২২), নাজমুল মোল্লা (২৩) ও সাইফুল ইসলাম (৩৪)। তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব দেশে মদ চোরাচালানে সক্রিয় বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটের মধ্যে একটির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে।
এদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে উক্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মুন্সিগঞ্জের একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা আজিজুল ইসলাম এই সিন্ডিকেটের প্রধান। দুই পুত্রকে নিয়ে সিন্ডিকেটটি পরিচালনা করেন। দুবাইয়ে অবস্থানকারী হোটেল ব্যবসায়ী নাসির তাদের মদের চালানের যোগান দেন। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মোহাম্মদ জাফর আহমদ ও শামীম তাদের সব চালান খালাস করার দায়িত্ব পালন করেন। কাস্টমসসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার লোকজনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে তারা ব্যবসাটি করছেন বলে আজিজুল ইসলামের পুত্র আবদুল আহাদ র্যাবের নিকট স্বীকার করেছেন। র্যাব আজিজুল ইসলামের অপর পুত্র আশিকসহ পুরো চক্রটিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে চালান আটকের পর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জাফর আহমদ ও শামীম গা ঢাকা দিয়েছেন। চক্রটি প্রতি মাসে একাধিক মদের চালান আনত। -দৈনিক আজাদী