কামরুননাহার : মজিদের বাড়ির হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে।সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। আকাশের কান্না যেন থামতেই চাইছে না। এর মধ্যে যেতে হবে রহমান মেম্বার এর বাড়ি। মেম্বার বাড়ি শালিস আছে।তাদের তিন জনকেই যেতে হবে।
মজিদের মেয়ে শানু।দেখতে বেশ।অতি সুন্দরি নয় তবে সুন্দর। ক্লাস নাইনের ছাত্রী। মেধাবী ছাত্রী সে।ফাইভ এ বৃত্তি পেয়েছিল। এইটে ও পেয়েছে। তাই হয়তো নজর পড়েছে রহমান মেম্বারের তিনবার এস এস সি ফেল করা ছেলে রাজুর। রাজু সব সময় মোটর সাইকেল নিয়ে স্কুলের পথে দাড়িয়ে থাকে।প্রেম নিবেদন করে শানুর আসা যাওয়ার পথে।সাথে থাকে তার সাগরেদ মাফুজ।কি কি বলে আর খিক খিক করে হাসে।চুপচাপ পাশ কেটে চলে আসে শানু প্রতিদিন। পরশু দিন মফিজ তাকে ভাবী, ভাবী করে ডাকাতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে শানু। ফিরে গিয়ে বলে ” আপনের মা, বইন নাই। ” রাজু শানুর সাহস দেখে গম্ভীর হয়ে যায়। মফিজ উত্তর দেয় ” মা, বইন ঘরে আছে ওর বউ নাই। ” হেসে ওঠে দুজন।
আপমান বোধ করে রাজু। সে রাতে শানুর ঘরের বেড়া কেটে মুখ বেধে ধর্ষন করে শানুকে। বাইরে পাহারায় থাকে মফিজ। কাজ শেষে চলে যায় তারা। কোন মতে শানু আসে মা বাবার দরজায় বলে সব। মা বলেন চুপ থাক,চুপ থাক।কাউরে কইস না।টিকতে পারমু না গেরামে।চুপ মা,বাবা,আর মেয়ে।যেন চুপ চুপ কান্না খেলছে ওদের ঘরে।
তবে ঘটনা গোপন থাকে না।রাজুর প্রিয় ভাবী রাহেলা জানিয়ে দেন সকলকে।তাই নিয়েই আজ মেম্বার বাড়ী শালিস। শানুর মা বার বার বলছেন এ কেমুন কথা আসামীর বাড়ী শালিস।কে শুনবে তার কথা।যেন নিজেকেই নিজের বলা।
সন্ধার আগেই তারা পৌঁছে যায় মেম্বার বাড়ি। আছে অনেকে।রাজুও আছে এককোনে।ঈমাম সাহেব ও আছেন।মেম্বারের হাতে বিশাল ছড়ি।তারা পৌঁছাতেই মেম্বার পিটাতে শুরু করেন ছেলেকে। শানু দেখে ভাবে কাকা এতো ভাল অন্যায় প্রশ্রয় দেয় না।এদিকে মেম্বার ছেলেকে মারছেন আর জিগ্যেস করছেন “হারামজাদা এ করলি ক্যান?”সকলে মার ঠেকাতে ব্যস্ত। এরমাঝেই রাজু বললো” আব্বা মাইরেন না যা করছি ভালোবাসা থেইকা করছি। ” আমার আর শানুর কোন দোষ নাই। আমরা দুই জন দুই জনরে ভালোবাসি।
মাথা চক্কর দেয় শানুর কত বড় মিথ্যা কথা কয় ও।শানু বলে ওঠে মেম্বার কাকা শুনেন,।তুমি চুপ থাকো, তোমার বাপের লগে কতা কমু।গম্ভীর কন্ঠ মেম্বারের।সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন আপনারা গেরামের গণ্য মান্য লোক আপনারা যে বিচার করবেন।আমি তাই মানবো।
শুরু হয় বিচার।ঈমাম সাহেব বলেন জেনা করা মহাপাপ। এদের দুইজনেরে দোররা মারা উচিৎ। যেহতু এগো বয়স কম আর দুইজন দুইজনরে ভালোবাসে,তাই যা হবার হইছে এহন এগো বিয়া দিয়া দেন।আপনেরা উভয় পক্ষ রাজি থাকলে আমি এহনি বিয়া পড়াইয়াদি।
গেরামের খবর বাইরে যাওয়া ঠিক না। গেরামের সকল মাইনষের বদনাম হয়।আর খারাপ কথা লইয়া আলোচনা করলে পাপ বাড়ে।
ঝিম মেরে বসে শুনছিলেন মেম্বার। এবার দাঁড়ালেন বললেন, ঈমাম সাহেব নামী মানুষ। উনার জ্ঞান অনেক উনি যা বলছেন আমি তাতে রাজি। যদিও মজিদের মত লোকের সাথে আমার আত্মীয়তা চলে না তবু ছেলে মেয়ের পছন্দ আমার অমত নাই।তুমি কি বল মজিদ?
গ্রামের লোক ধন্য ধন্য করতে থাকে মেম্বারের মহানুভবতায়।মজিদ নির্বাক।একজন বলে ওঠে ঐ মজিদ কথা কস না ক্যা। মজিদ চুপ।আরেক জন বলে ঐয়ে কি কইবো মেম্বার বাড়ি মাইয়া দিব, এহানে কওনের কি আছে?
জ্ঞান হারায় শানু। মেয়ে অসুস্থ তাই বিয়ের দিন পিছিয়ে যায়।সামনে জুম্মা দিন বিয়ে।মজিদের কোন খরচ নাই মেম্বার বাড়ি রান্নাবান্না হবে।সকলে সে বাড়িতে খাবে।খুশি গায়ের লোক।
মজিদ মেয়েকে নিয়ে বাড়ি আসে।শানু বাবার পা ধরে অনুনয় করে আব্বা আমারে বাচাও।মেয়ের পিঠে হাত রাখে বাবা।স্নেহের সুরে বলেন,বাচামু মা।আমি মইরা গেলেও তরে বাচামু।রাতের আধারে গ্রাম ছাড়ে চারটি প্রানী। শানু তার মা,বাবা ভাই।
শহরে অটো চালায় মজিদের ভায়রা।তার ওখানে ওঠে।অনেক ভালো ছাত্রী হওয়ায় শানুও একটা ভালো স্কুলে পড়বার সুযোগ পায়।অটো চালায় মজিদ।অনেক পরিশ্রম করে।শানুর মা কাথা সেলাই করেন।ছেলে মেয়ে দুটি লেখা পড়ায় খুব ভালো।
পনেরো বছর পরে ডাক্তার শাহানারা এলেন অল্প বয়সী একটি মেয়েকে দেখতে। জানতে চাইলেন কি হয়েছিল।জানলেন গ্রামেের মেম্বারের ছেলে তার তিন বন্ধুকে নিয়ে মেয়েটিকে নির্যাতন করেছে।বলতে গিয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছে মা আর মেয়ে।ধমক দেন শাহানার তোমরা লজ্জা পাচ্ছ কেন? কোন বাড়িতে চুরি হলে বাড়িওয়ালা লজ্জা পাবে? না চোর লজ্জা পাবে?মা তুমিতো সম্পদশালী। ঔ কুলাংগার চোর। তোমার কোন লজ্জা নেই।
একথাটি তাকে বলেছিল স্বামী ডাক্তার আশফাক।যখন তাদের বিয়ের কথা হয় শানু সব বলেছিল আশফাককে।
জানতে চান কোথা থেকে এসেছে তারা।পরিচয় যেনে বুকের ভেতর কাঁপছে শাহানারার। এযে রাজুর মেয়ে সাবিনা।রাজু এক বছর ক্যানসারে ভুগে সমস্ত সম্পত্তি শেষ করে বছর দুই আগে মরেছে।এখন মেম্বার মফিজ।আর তার ছেলে ঘটিয়েছে ঘটনা।
বারোদিন পর সাবিনা একটু সুস্থ হলে ডাক্তার শাহানারা তাদের বাসায় নিয়ে আসেন।মজিদও পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন।তার মা এসেছে কদিন হলো।তার ছোট সাবজজ ভাইটা মাকে ছাড়তেই চায় না। মা জিগ্যেস করেন এরা কারা? শাহানারা বলেন এ রাজুর মেয়ে আর স্ত্রী। মা বলেন শানুরে তুই রাজুর মেয়েরে সাহায্য করবি। শানু বলে হা মা করবো। রাজুর মেয়েকে নয়।
আমি দাঁড়াব একটা অসহায় মেয়ের পাশে।আর এক অসৎ মেম্বারের বিরুদ্ধে। আজ আমি চুপি চুপি এদের গ্রাম ছাড়তে দেব না।
লেখক : শিক্ষিকা ও সাহিত্যিক।