কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাস করছে। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, ময়নারঘোনা, তাজনিমারখোলা, শফিউল্যাহকাটা ও জামতলির পাহাড়ি এলাকায় এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প করে আশ্রয় নিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে অতিবর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে পালংখালী ইউনিয়ন ও সংলগ্ন এলাকাগুলো বন্যায় প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বসতবাড়ি নিমজ্জিত ও পাহাড়ধসে প্রতি মৌসুমে এখানে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। তাই এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ঝুঁকি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতির উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসন। রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিমধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার শেড বা ঘর নির্মাণ করেছে সরকার। এর বাইরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পাহাড়চূড়া, ঢালু ও নিচু এলাকায় যত্রতত্র মাটি কেটে ঝুপড়ি বেঁধে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে আরও প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এসব ন্যাড়া পাহাড় ভারি বর্ষণে ধসে পড়ে ব্যাপক আকারে রোহিঙ্গাদের প্রাণহানি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রশাসন ও পরিবেশবাদীরা। পাহাড়ধসে প্রাণহানি রোধে এবং রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রশাসনিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, আবাসনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়। পর্যায়ক্রমে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে বলে জানান বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান। তবে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধস রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্প এলাকার অধিকাংশ বনভূমি, উঁচু-নিচু পাহাড় কেটে মাটির শ্রেণি পরিবর্তন করে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। তবে বর্ষাকালে তাদের অবস্থা কী হবে এ নিয়ে রোহিঙ্গারা একবারও ভাবছে না। স্থানীয় চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, প্রতি বর্ষায় পালংখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন হয়ে বন্যা দেখা দেয়। পাহাড়ি ঢলের পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যায়। প্রাণহানি ও নিখোঁজের মতো ঘটনাও ঘটে। রোহিঙ্গারা যে পাহাড় কেটে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছে, তাদের অবস্থা বর্ষাকালে কী হবে এ নিয়ে প্রশাসনের ভাবতে হবে। বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইতিমধ্যে ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গাদের আবাসন সম্পর্কে অবগত হয়েছি। বর্ষাকালে রোহিঙ্গারা যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে কোথাও সরিয়ে নেওয়াও যাবে না। স্থানীয় সচেতন মহল ও পরিবেশকর্মীরা জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢালু ও থলিতে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছে। রোহিঙ্গা ঢলের পর যত্রতত্র পাহাড় কেটে বসবাস শুরু করায় ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। গত বছর আগস্টের শেষে ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে রোহিঙ্গা আসার ঢল নামায় যে যেখানে পেরেছে সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। কিন্তু আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিরাপদ স্থানে না নিলে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক সাইফুল আশরাফ বলেন, বর্ষাকালে পাহাড়ধসে এসব রোহিঙ্গার প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সমতল স্থানে নিয়ে যাওয়া হলে সরকারের বনভূমি রক্ষার পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও পাহাড়ধসের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রোহিঙ্গাদের প্রাণহানির আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, উখিয়ায় আশ্রিত ৭ লাখ রোহিঙ্গার অধিকাংশ পরিবারই পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে এসব রোহিঙ্গার মল-মূত্র, বর্জ্যসহ নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা লোকালয়ে চলে আসতে পারে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার, যেখানে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে। ইতিমধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার শেড বা ঘর নির্মাণ করে রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বর্ধিত ক্যাম্প এলাকা আলোকিত করতে ৯ কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ক্যাম্পে পরিবেশবান্ধব চুলা সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ১৮ কিলোমিটার ও এলজিইডির মাধ্যমে ৯ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সবাইকে নিয়ন্ত্রণের জন্য উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ২০টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। একেকটি ব্লকে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা থাকবে। এই ৩৫ হাজার মানুষের জন্য আলাদা শেড, আলাদা মসজিদসহ অন্য সব ব্যবস্থা করা হবে। এতে পাহাড়ধসসহ নানামাত্রিক ঝুঁকি কমে আসবে।