ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় কতটা প্রস্তুত উপজেলার হাসপাতাল

সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় কতটা প্রস্তুত উপজেলার হাসপাতাল

নিউজ ডেক্স : লোহাগাড়া উপজেলায় ২২ মে সাপের কামড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়। রেহেনা আক্তার নামে ওই রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলেও দায়িত্বরত চিকিৎসকরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রেফার করেন। তবে চমেক হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তার মৃত্যু হয়। রেহেনা লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজান গ্রামের মৃত নুর মোহাম্মদের স্ত্রী।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাড়িতে আলমারির ভেতর থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে কিছু একটার কামড় অনুভব করেন ওই নারী। পরিবারের অন্যদের বিষয়টি জানান। তারা ধারণা করছিলেন চিকা জাতীয় কিছু কামড় দিয়ে থাকতে পারে। উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা রোগীকে চট্টগ্রামে রেফার করেন। পরে পথেই তার মৃত্যু ঘটে।

এর একদিন আগে বাঁশখালী উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। বাহারছড়া এলাকার ওই নারী প্রাথমিকের একজন শিক্ষক ছিলেন। ঘরে খুপি থেকে মুরগি বের করতে গেলে সাপের দংশনের শিকার হন। উপজেলা হাসপাতালের পরিবর্তে রোগীকে চমেক হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে দেরি করায় হাসপাতালে আসার আগেই ওই নারীর মৃত্যু ঘটে। চিকিৎসকদের ধারণা, সাপের কামড়ের পর ওই রোগীকে ঝাড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, সাপে কাটার প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা পর রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়। অথচ বাঁশখালী থেকে চমেক হাসপাতালে আসতে এতটা সময় লাগার কথা নয়।

দুটি ঘটনাই জানান দিচ্ছে, এই সময়ে মানুষের আবাসস্থলে সাপের উপদ্রব বেড়েছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় মোখা পরবর্তী নিজেদের আবাসস্থল হারিয়ে সাপের মতো বিষধর প্রাণী লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। যার কারণে সাপের কামড়–পরবর্তী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কতটুকু? সাপে কাটা রোগীর জরুরি চিকিৎসা দিতে প্রান্তিক পর্যায়ের এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কি সক্ষম?

প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কতটা : চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরাঞ্চলের তুলনায় প্রান্তিক বা গ্রামীণ পর্যায়ে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেশি। সাপে কাটার পর একজন রোগীকে প্রথমে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে নেয়া হয়। তাই উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর জরুরি চিকিৎসা সুবিধা থাকা জরুরি। বিষধর সাপের কামড়ের চিকিৎসায় এন্টিভেনম ইনজেকশন সবচেয়ে কার্যকরী বলে বিবেচনা করা হয়। এন্টিভেনম এতদিন উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সরবরাহ ছিল না।

তবে বেশ কিছুদিন ধরে এন্টিভেনম সকল উপজেলা হাসপাতালে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় একটি এন্টিভেনম দেয়া হয়। আগে এভেইলেবল না থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের আভাসের পর এন্টিভেনমটি সব উপজেলা হাসপাতালে নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন সব উপজেলা হাসপাতালেই এন্টিভেনম রয়েছে। এছাড়া সাপে কাটা রোগীর জরুরি চিকিৎসায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতিটা উপজেলা হাসপাতালে কম–বেশি অনেক চিকিৎসকই এই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাপে কাটা ওই রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে চট্টগ্রামে রেফার্ড করার কারণ সম্পর্কে সিভিল সার্জন বলেন, তারা কী কারণে এমনটা করল জানি না। ঘটনাটি তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটি ঘটনাটি তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে।

একাধিক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (ইউএইচএফপিও) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলছেন, হাসপাতালে এন্টিভেনম মজুদ রয়েছে। তবে কেউ কেউ পেলেও চিকিৎসকদের সবাই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় প্রস্তুতি ও সক্ষমতা জানতে লোহাগাড়ার ইউএইচএফপিও ডা. মো. হানিফের মোবাইলে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এন্টিভেনম মজুদ রয়েছে জানিয়ে বাঁশখালীর ইউএইচএফপিও ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসাররাও সাপে কাটা রোগীর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম। তবে চিকিৎসকদের মাঝে কতজনের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি। গত সপ্তাহে সাপের কামড়ে মৃত্যু হওয়া রোগীকে উপজেলা হাসপাতালে আনা হয়নি বলেও জানান তিনি।

হাটহাজারীর ইউএইচএফপিও ডা. রশ্মি চাকমা বলেন, হাসপাতালে বর্তমানে ৩০টির মতো এন্টিভেনম মজুদ রয়েছে। সাপে কাটা রোগী এলে আমরা প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত রয়েছি। তবে হাসপাতালের সব চিকিৎসক এখনো এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি। প্রশিক্ষণটাও যেহেতু প্রয়োজন এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।

সাপে কাটা ও করণীয় : বিশেজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাসে (অর্থাৎ বর্ষাকালে) সাপের উপদ্রব বাড়ে। বিশেষ করে বন্যা বা ঝড়ের পর বিষধর পোকামাকড় ও সাপ তাদের আবাস হারিয়ে উঁচু জায়গা খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা মানুষের আবাসস্থলে ঢুকে পড়ে। তখনই সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে।

বিষধর সাপের কামড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর মূল কারণ সচেতনতার অভাব বলে মনে করেন চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রবিউল আলম। তিনিসহ মেডিসিন ওয়ার্ডের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছেন। গত সপ্তাহে দুই উপজেলায় সাপের কামড়ে মারা যাওয়া দুজন রোগীকেই আনা হয় চমেক হাসপাতালে। দুজন রোগীরই হিস্ট্রি নেন ডা. রবিউল আলম। তিনি মনে করেন, ওঝা বা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা করা এবং হাসপাতালে আনতে দেরি করার কারণেই সাপে কাটা অনেক রোগীর অকাল মৃত্যু ঘটে। অথচ কেবল দংশন করা স্থানটির নড়াচড়া বন্ধ করে দ্রুত হাসপাতালে আনা হলে অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব।

সাপে কাটার পর করণীয় সম্পর্কে ডা. রবিউল আলম বলেন, সাপ হাতে বা পায়ে কামড়ালে দেখা যায় মানুষ আক্রান্ত অংশের উপরে রশি বা গামছা দিয়ে টাইট করে বাঁধে। এটা করা যাবে না। সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো দংশিত স্থানের (হাতের বা পায়ের) দুপাশে বাঁশের বা কাঠের ফালি কিংবা কাঠি দিয়ে তার উপর আলতো করে বাঁধা, যেন নড়াচড়া কম হয়। বেশি টাইট করেও বাঁধা যাবে না। এমনভাবে বাঁধতে হবে, যেন আক্রান্ত স্থান ও কাপড়ের মাঝে কষ্ট করে একটি আঙুল ঢোকানো যায়। এভাবে বেঁধে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পায়ে কামড়ালে রোগীকে হাঁটানো যাবে না। অন্য উপায়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে হাতে কামড়ালে সেটি নড়াচড়া না হয় মতো ব্যবস্থা করে হঁাঁটানো যাবে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাকিটা চিকিৎসকরাই দেখবেন।

তিনি বলেন, আক্রান্ত স্থানে অন্য কোনো কিছুই লাগানো যাবে না। ঝাড়ফুঁক করে সময়ও নষ্ট করা যাবে না। সময় নষ্ট করলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। বাঁশখালীর রোগীটা অনেক দেরিতে হাসপাতালে আনা হয়। যার কারণে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যু হয়েছে। সাপে কাটার পর তারা ঝাড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করে থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। কারণ, সাপে কামড়ানোর প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা দেরিতে তারা রোগীকে হাসপাতালে আনে। তাছাড়া রোগীর আক্রান্ত স্থানে তারা শিমের বিচি জাতীয় কিছু লাগিয়েছিল বলে আমাদের মনে হয়েছে।

পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সুযোগ থাকলে দংশন করা সাপটির একটি ছবি তুলে রাখতে পারলে ভালো হয়। কারণ সাপটি বিষধর ছিল কিনা, চিকিৎসকরা সাপের ছবি দেখে নিশ্চিত হতে পারবেন। এতে করে রোগীর চিকিৎসায় সুবিধা হয়। বিষধর সাপ কামড়ালে চিকিৎসক দ্রুত এন্টিভেনম ইনজেকশন প্রয়োগ করবেন। এছাড়া যেসব স্থানে সাপ অবস্থান করতে পারে (যেমন লাকড়ি রাখার স্থান, হাঁস–মুরগি রাখার স্থান, খাটের নিচে, আলমারি ও ঝোপঝাড়), সেসব স্থানে চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি।

বর্তমানে সকল উপজেলায় সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে জানিয়ে ডা. রবিউল আলম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি অধ্যাপক এম এ ফয়েজ স্যারের নেতৃত্বে এ চিকিৎসা সুবিধা বিস্তৃত পরিসরে বাড়ানোর কাজ চলছে। এর আওতায় এন্টিভেনম এখন সকল উপজেলায় দেয়া হচ্ছে। আগে ছিল না। চিকিৎসকদের জন্য প্রতি মাসের প্রথম বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ননকমিউনিকেবল ডিজিজ) তত্ত্বাবধানে অনলাইনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া এম এ ফয়েজ স্যারসহ ঢাকা–চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলার চিকিৎসকদের সমন্বয়ে ‘স্ন্যাক বাইট সাপোর্ট গ্রুপ’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু আছে। সাপে কাটা কোনো কেস পাওয়া গেলে তা নিয়ে এ গ্রুপে আলোচনা ও প্রয়োজনে চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া হয়।

যা করা যাবে না : চিকিৎসকরা বলছেন, সাপে কাটলে আক্রান্ত স্থান কাটা, দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, আক্রান্ত স্থান থেকে মুখের সাহায্যে রক্ত বা বিষ টেনে বের করার চেষ্টা করা, আক্রান্ত স্থানে গোবর, শিমের বিচি, আলকাতরা, ভেষজ ওষুধ বা কোনো ধরনের রাসায়নিক লাগানো, কার্বলিক অ্যাসিড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে দংশিত জায়গা পোড়ানো, গাছ–গাছড়ার রস দিয়ে প্রলেপ দেওয়া ইত্যাদি করা যাবে না। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!