ব্রেকিং নিউজ
Home | সাহিত্য পাতা | শুভ্রতার সুখ-দুঃখ (১৩ তম পর্ব)

শুভ্রতার সুখ-দুঃখ (১৩ তম পর্ব)

328ফিরোজা সামাদ : সবকিছু পিছু ফেলে ভালোবাসার হাতছানি, চাওয়া না পাওয়া সব ভুলে গিয়ে অাত্মসমর্পণ করলাম এক শূন্যতার মাঝে। এই শূন্যতাই যেনো পূর্ণতা পায় এই বাসনা পুষলাম বুকের খাঁচায় ।

সৌদিয়া বিমানটি অবতরনের পর অামি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতেই দেখলাম সিকিউরিটি সাথে নিয়ে অারিফ অামায় খুঁজছে।  অামি মন্ত্রমুগ্ধের মতো অামার ডান হাতটি উপরে তুলতেই অারিফ হাসি মুখে অামার দিকে এগিয়ে এলো।  এই প্রথম অামি অারিফের হাস্যজ্জল মুখ দেখলাম।  মনে মনে একটু খুশিও হলাম।  হাসিমুখে অারিফকে বেশ ভালো লাগছে।।বিদেশ বিভুইয়ে অারিফকেই কেমন যেনো অাকড়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। অামাকে অামি প্রস্তুত করে নিলাম সময়ের সাথে মিলিয়ে চলতে। অারব অামিরাতে গিয়ে দেখলাম অারিফ যে হাসপাতালটিতে চাকুরি করে সেটা অনেকখানি জায়গা নিয়ে মরুভূমির উপর দাড়িয়ে অাছে। মনে হচ্ছে কোনো এক শহর। মূলতঃ ওটা একটি হাসপাতাল সাথে ডাক্তার ও অন্যান্য কর্মচারীদের অাবাসিক কোয়ার্টার। বেশ কয়েকটি ধাবা, কয়েকটি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, শপিংমল। অারো কতোকিছু ! বেশ ভালোই লাগলো। অারিফের কোয়ার্টারটি খুব গোছানো।  সামনে অবাঙ্গালি গার্ড। কিন্তু কোনো কাজের বুয়া বা বয় নেই। বুঝলাম এটা অামাকেই সামলাতে হবে। রাতের খাবার অারিফ ধাবা থেকেই নিয়ে এলো। তাই টেবিলে সাজিয়ে খেয়ে নিলাম দু’জন।  তবে অাশ্চর্য হলাম, অামার মধ্যে কোথাও কোনো জড়তা খুঁজে পেলাম না !  মনে হলো অারিফের সাথে যেনো অামার কতোযুগের পরিচয়! সত্যি দিন বদলায়,  সময় বদলায়, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বদলায় মানুষের মন। তাই বোধহয় বদলে গেলাম অামার অামিও।

এবার রাতে শোবার ঘরে শুতে এলাম।  অারিফের সাথে বিয়ের পর অামার যে সম্পর্ক হয়েছে, তাতে কোনো প্রাণ ছিলোনা।  মনে হয়েছে কোনো রকম চোখ কান বন্ধকরে সময়টুকু পাড় করা।  তারপর নিজের শরীরটাকে নোংড়া মনে হয়েছে।  তাড়াতাড়ি গোসল করে নিতাম।

সেদিনও শুতে গিয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো।  কিন্তু অারিফ খুব অান্তরিকতার সাথে অামায় বুকে টেনে নিলো।  অামি অালোটা নিভিয়ে দিলাম।  অারিফ ঘনিষ্ঠ হতেই অামার মনের চোখে মারুফের মুখটা হঠাৎ জ্জ্বল জ্জ্বল করে উঠলো।  অামি ভুলে গেলাম পৃথিবীর সব, ভুলে গেলাম, অামার বিয়ে হয়ে গেছে,  অামার স্বামী অাছে। অামি দেহে মনেপ্রাণে মারুফের শুধু মারুফের হয়ে গেলাম।  অারিফ খুউব খুশি অামার অাচরণে। অারিফ  হঠাৎ অালো জ্বালিয়ে দিতেই অামি লজ্জায় অারষ্ট হয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে চলে গেলাম। সেদিন থেকে অাবিস্কার করলাম প্রতি রাতে অালো নিভিয়ে দিলেই মারুফ চলে অাসে অামার বিছানায় অার অামি তখন শুধু মারুফের হয়ে যাই। মাঝে মাঝে ভাবতাম অামি কি দ্বিচারিণী ?  অাবার ভাবি অামার ঈশ্বর কেনো অামাকে এমন পরিস্হিতিতে ফেললো? অামার মনকে কেউই যখন বুঝলোনা, তাহলে অামার এই গোপন সুখটুকু থেকে কেনো অামি বঞ্চিত হবো ?

জীবন চলে যাচ্ছে জীবনের গতিতে। ওকে দমিয়ে রাখা যায়না। অামার জীবনেও দেখলাম,  পেছনের কষ্ট ঝেড়ে ফেললে অামি একজন সুখি মানুষ। তাই শুধু রাতের অন্ধকার ছাড়া অামি ভুলে গেলাম অতীত । দেশে শুধু মায়ের সাথেই অামার যোগাযোগ ছিলো, চিঠি কিংবা ফোনে।।অারিফের কোয়ার্টারে সর্বত্রই অামার বিচরণ থাকলেও একটি জায়গা ছিলো অামার জন্য অবরুদ্ধ। সেটা একটি ওয়াল কেবিনেট। যেখানে সুরক্ষিত একটি ব্রিফকেস। ওই কেবিনেটের চাবী সবসময়ই অারিফ অাগলে রাখে। বিষয়টি অামার বুকে একটি কাঁটার মতো বিঁধতো।।অাবার ভাবতাম ওরও তো একটা অতীত থাকতে পারে, যেখানে প্রাঞ্জল ভালোবাসা ছিলো।  হয়তো ভুলতে পারছেনা অামারই মতো। এমনি ভেবে নিজেকে ওখান থেকে সড়িয়ে অানতাম, ওটা ওর একান্ত ব্যক্তিগতজীবন ভেবে। একটি বছর বেশ ভালোই কেটে গেলো। অারিফ বাংলাদেশে ফিরবে জানালো।  অামি অবাক! বললাম

অামিও তোমার সাথে যাবো ।

না অামি বরগুনায় যাচ্ছিনা। বিশেষ
প্রয়োজনে অামার বাড়ি যাচ্ছি।
পনেরো বিশ দিন থেকে চলে অাসবো।

তাতে কি ?  অামি তো তোমার বাড়ি
কখনো যাইনি, অামাকে সাথে নিয়ে
যাও।  সবার সাথে দেখা করে অাসবো,
তাছাড়া এখানে অামি একাই বা
থাকবো কি করে ?

একা থাকবে কেনো? তুমি এই ক’টা
দিন ডাক্তার সাহেদে ভাইয়ের বাসায় ভাবীর
সাথে থাকবে, মে রকমই কথা হয়েছে
সাহেদ ভাই ও ভাবীর সাথে।

অামি অবাক হলাম।  সব ব্যবস্হা অামাকে না জানিয়েই পাকা করে ফেললো ? মনের কোণায় অনেক প্রশ্নরা ঘোরাফেরা  করতে থাকে। কোয়ার্টারে ল্যাণ্ডফোন অাছে, কিন্তু  কোনোদিও পিরোজপুর থেকে অর্থাৎ অারিফের বাড়ি বা ওর অাত্মিয় স্বজনদের কোনো ফোন অাসেনি। ও কেনো বাড়ি যেতে চায় বিষয়টি অামার মনের কোণায় সন্দেহের বাসা বাঁধে।  তারপরও কিছুই করার নেই। একসময় অামাকে ডাঃ সাহেদ ভাই ও ভাবীর তত্ত্বাবধানে রেখে বাংলাদেশ চলে অাসে।  অামি লান্ডফোনে মা’কে জানালাম ” তোমাদের জামাই দেশে গিয়েছে, যত্ন অাত্তি করো “। বাইশদিন পর অারিফ ফিরে এলো।  ওকে বেশ ঝরঝরে মনে হলো।  অাবার সব সংশয় একপাশে রেখে সংসারে মনোনিবেশ করলাম।  এমনি করে পাঁচটি বছর কেটে গেলো।  বছরে একবার অারিফ বাংলাদেশে অাসে পনেরো বিশ দিন থেকে অাবার চলে যায়।  তবে এই পাঁচ বছরে একবার অামার মা বাবার সাথে দেখা করেছে। কি বলেছে, অামি কারোর কাছেই জানতে চাইনি। পাঁচ বছর পেড়োতে না পেড়োতেই একদিন অাবিস্কার করলাম অামি মা হতে যাচ্ছি। কয়েকমাস যেতে না যেতেই ডাক্তার বললেন টুইন বেবী।  অামার তো মাথায় হাত!  দুটো বেবী কীকরে লালন পালন।করবো ?  কিন্তু বাচ্চা প্রসবের পর দেখা গেলো সময় ও পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে বেশ সামাল দিতে পারলাম।  মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে ভেবে অাশ্চর্য হতাম। কতোদিন গেছে অায়নার সামনে বসতে সময় হয়নি।  তারপরেও কোনো অভিযোগ অাল্লাহ বা কোনো মানুষের প্রতি রাখিনি।  জীবন চলছে জীবনের গতিতে।  টুইন বেবী দুটি যখন ছোট ছিলো বুঝতে পারিনি ওরা দেখতে কার মতো হয়েছে। বয়স যখন মাস তিনেক একদিন লক্ষ্য করলাম অারে!  এই মুখ তো খুব চেনা!  অামিই অাবিস্কার করলাম দু’টো বেবীই হুবহু দেখতে মারুফের মতো। মনে হয় মারুফের মুখটি ছোট্ট করে ওদের মুখে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।  হা বিধাতা তুমি অামায় অার কতো কি হা বিধাতা তুমি অামায় অার কতো কি দেখাবে।  এতো মীরাক্কল ? শুনেছি বাচ্চা গর্ভকালীন মা যা কল্পনা করে ভাবে সন্তানের উপর তার প্রভাব পড়ে।  তাহলে ! নিজেকে অপরাধী ও লজ্জিত মনে হলো। ওদের যখন পাঁচ বছর বয়স, ওদের মুখ দু’টি দেখতে স্পষ্ট “মারুফ”। বিধাতা অামায় এমন শাস্তি দিলেন যা সারা জীবন অামাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!