শীলা ঘটক : ইনবক্সের একটা ম্যাসেজে চোখ আটকে গেল আকাশের। নাম মেঘবতী। নামটা ভালো লেগেছিল বলে অনেকদিন আগে বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করেছিল সে। কিন্তু একদিনও কথা হয়নি মেঘবতীর সাথে। প্রোফাইল পিকচারে কোন মেয়ের ছবি ছিলনা। ছিল শুধু আকাশের ঘন কালো মেঘের ছবি।
‘নিশ্চয় ভুলে গেছিস আমাকে? ভুলে যাবারই কথা। পঁচিশ বছর আগের কথা কে আর মনে রাখে বল! কেমন আছিস তুই? বিয়ে করেছিস নিশ্চয়ই। প্রোফাইলের কোথাও তোর বৌ বা বাচ্চার ছবি দেখলাম না, তাই জিজ্ঞেস করছি’।
আকাশ বার বার ঘুরেফিরে ম্যাসেজটা পড়ছিল। কে হতে পারে! কাউকে মনে পড়ছে না তো! মেঘবতীর প্রোফাইলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও কিছু বের করা গেল না। কে হতে পারে! মনে হোল কেউ হয়তো ইয়ার্কি করেও এমন ম্যাসেজ পাঠিয়ে থাকতে পারে।
মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়ে আকাশ ঘুমিয়ে পড়লো। পরের দিন আবার অফিস যেতে হবে। তাড়াতাড়ি উঠে কিছুটা সময় জিমে কাটিয়ে আসে তারপর অফিস যাবার সময় হয়ে যায়। অফিস বলতে তার নিজের অফিসেই সে যায়। অন্য কোথাও চাকরি করেনা। মেডিসিনের ব্যবসাটা শুরু করেছিল আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। তখন বয়স খুবই কম। বছর একুশ হবে তখন। সেই একটা সময় ছিল। মনে পড়লে মনের ভেতরে যেন উল্কাপাত হতে থাকে! কলেজ, প্রাইভেট পড়তে গিয়ে গঙ্গার ধারে আড্ডা দেওয়া। আকাশের গীটারের সুরের মূর্ছনায় পথ চলতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়তো সেই সুর শুনে! গানের তালে তালে হাততালি দিয়ে সবাই গলা মেলাতো সুমনের সেই বিখ্যাত গান , ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই, ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই’—— সুরমা প্রায়ই সময় সেই গানের যেকোন জায়গা থেকে হঠাৎ করে গেয়ে উঠত, ‘ বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই………
অফিসে এসেও আকাশ ভালো করে মন বসাতে পারছেনা কাজে। বার বার টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটার ওপর চোখ পড়ে যাচ্ছে আকাশের, আবার কিছু লিখলো কিনা দেখার জন্য মনটা উত্তেজিত হয়ে উঠছে বার বার। খুলে দেখতে গিয়েও আবার পাশে সরিয়ে রেখে দেয়। কয়েকজন এম আর এসেছে দেখে মোবাইলটা খুলতে গিয়েও খোলা হোলনা।
দুপুরে কর্মচারীরা অফিসের বাইরে গেলে এই সুযোগে চটপট মোবাইলের মেসেঞ্জার খুলে দেখলো মেঘবতী কিছু লিখে রেখেছে কিনা। দেখল লেখা আছে বেশ অনেক বড়সড় একটা ম্যাসেজ।
আমি এখন অনেকদূরে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের অন্য কোন দেশের বাসিন্দা। সাদা বরফে ঢেকে থাকে সারা শহর। শীতকালে শহরের রাস্তাঘাট, গাড়ি, মুহূর্তের মধ্যে তুষারপাতে সাদা বরফে ঢেকে যায়। আল্পস্ আর জুরা পর্বতে ঘেরা সারা শহরটা। যখন আমি প্রথম আসি এখানকার ফরাসীভাষীদের কথা কিছুই বুঝতামনা। তাদের আদপ কায়দা সব আলাদা। খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাদের দিকে। জানুয়ারি মাসের ঠাণ্ডা তো সহ্য করা যায়না! শীতকালের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়লে আমি চলে আসতাম ওই সময়ে কোলকাতায়। এবার তোকে বলি কোথায় থাকি আমি এখন, দেশ টার নাম জেনেভা। সুইজারল্যান্ডের একটা ছোট শহর জেনেভা। খুব সুন্দর শহর! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না! অসাধারণ বললে কম বলা হবে।
স্যার, একজন এসেছে দেখা করতে, ছেলেটির গলার আওয়াজে চোখ তুলে তাকায় আকাশ। ফোনটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়ে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আসুন আসুন’। ব্যবসার জন্য প্রায়ই সময় কেউ না কেউ আসে কথাবার্তা বলার জন্য। চার, পাঁচজন কাজ করে আকাশের অফিসে। তার মধ্যে অমিত ছেলেটি আকাশের বেশ প্রিয়। আকাশের খুব কথা শোনে।
‘স্যার খাবার নিয়ে আসি?’ অমিতের কথায় চোখ তুলে তাকালো আকাশ। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো নিয়ে আসার জন্য। অমিত বেরিয়ে গেলো খাবার আনতে। দুপুরের খাবার বাইরে থেকেই খেয়ে নেয় ও। একটু ফাঁকা দেখে আবার মোবাইলের ম্যাসেজ খুলে পড়তে শুরু করে। অনেক বছর আগের ফেলে আসা শহর কোলকাতা এখন অনেক বদলে গেছে রে আগের মানুষগুলো যেন হারিয়ে গেছে! খুব মন খারাপ হয়! বছর পাঁচেক আগে গেছিলাম, ভালো লাগেনি রে! একেবারেই ভালো লাগেনি! পুরনো জায়গাগুলো একা একা ঘুরে বেরিয়েছি। খুঁজেছি তোকে ভীষণভাবে খুঁজেছি তোকে, বিশ্বাস কর। অনেক কথা বলার আছে তোকে না বলা পর্যন্ত আমি শান্তিতে মরতেও পারবো না। রাত দুটো বাজে। এবার ঘুমাই কেমন, গুড নাইট।
মোবাইল বন্ধ করে ভাবতে থাকে সেদিনের সেই দিনগুলোর কথা। ভাবনার গভীরে ডুবে যাবার কোন সুযোগ নেই, অফিসে বসে থাকা মানেই কেউ না কেউ এসে ডাক দেয়।
অফিস বন্ধ করতে করতে প্রায় রাত আটটা বেজে যায়। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে কথাগুলো। কে হতে পারে!? নিজেকেই বার বার প্রশ্ন করে আকাশ। ক্রমশঃ