Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | মাতামুহুরী ট্র্যাজেডি : এমশাদের যে চিঠি সবাইকে কাঁদায়

মাতামুহুরী ট্র্যাজেডি : এমশাদের যে চিঠি সবাইকে কাঁদায়

Aminul-Hossain

নিউজ ডেক্স : পিইসি ও জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া চকরিয়া গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আমিনুল হোসাইন এমশাদ আগামী ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষাতেও যাতে সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারে সেজন্য ভর্তি হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরের একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে। এজন্য নগরীর চকবাজারে একটি বাসাও ভাড়া নেন এমশাদের বাবা আনোয়ার হোসাইন। সেই বাসায় উঠার কথা ছিল গতকাল (১৬ জুলাই)। তাই আগে থেকেই সবকিছুই ঠিকঠাক করা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের সহপাঠীদের ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে যেতে হবে, এই কষ্ট মেনে নিতে পারছিল না এমশাদ। তাই ১৪ জুলাই সকালে সহপাঠীদের উদ্দেশ্যে নিজের খাতায় মর্মস্পর্শী একটি চিঠি লিখে রাখে। তাঁর মৃত্যুর পর সেই চিঠিটা খুঁজে পেয়ে মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা সেটি পড়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। গতকালও তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এমশাদের মা–বাবা ও চাচা–চাচীসহ আত্মীয়–স্বজনরা চিঠিটি পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।

চিঠিতে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে এমশাদ লিখে, ‘জানি না হায়াত কত দিন আছে। হয়ত আজ আছি কাল নেই। তবু যতদিন বাঁচব তোদের সবাইকে সাথে নিয়ে বাঁচব। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১২টি বছর তোদের সাথে আছি। হয়ত আর দেখা হবে না। কিন্তু আমি তোদের কোনোদিন ভুলব না। এসএসসির পরেও তোদের সাথে যোগাযোগ থাকবে। তোরাও আমার সাথে যোগাযোগ রাখিস। তা না হলে খুব একা হয়ে যাব। ছেলেদের মধ্যে ১ম বেঞ্চের ৪ জন আমার বয়ফ্রেন্ড। আর গার্ল ফ্রেন্ডের মধ্যে রিতু। কোথাও চলে গেলে, যাই হোক না কেন যোগাযোগ বন্ধ করিস না। ১২ বছর তোদের সাথে অনেক ঝগড়া করেছি, খুব মজা পাইছি। ১২ বছর তোদের সাথে খুব সুন্দর ভাবে কাটিয়েছি। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো আমার জীবনে আর কোনোদিন আসবে না। আমি নিয়মিত নামাজ ও কুরআন পড়ি। আর চেষ্টা কবর ধরে রাখার জন্য। এসএসসির পরে তোদের জন্য একটা বার্থ ডে ট্রিট থাকবে, চিন্তা করিস না।’

মর্মস্পর্শী এই চিঠিটি দেখে ইমরানুল হোসাইন নামে একজন ফেসবুকে লিখেন, ‘আসলে যারা মারা যান তারা কেন জানি আগে থেকেই মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পারেন। এমশাদের এই চিঠিটি তারই নিদর্শন বহন করে!’

চকরিয়া পৌরশহরের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসাইন বন্ধুদের উদ্দেশ্যে পুত্র এমশাদের লেখা সেই চিঠি হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘কোনোদিন কল্পনাও করিনি আমার বুকের ধন দুই মানিককে চিরতরে কেড়ে নেওয়া হবে। আল্লাহ! এখন আমি কাকে নিয়ে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকব। আমার আগে কেন আমার দুই ছেলেকে কেড়ে নিলে? আমি এই দুনিয়ায় আর বেঁচে থাকতে চাই না।’

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় একসঙ্গে দুই পুত্রকে হারানোর পর থেকে নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন মা নার্গিস আক্তার। আত্মীয়–স্বজনরা চেষ্টা করেও তাকে কিছুই খাওয়াতে পারছেন না। শুধু বলছেন, ‘আমার মানিকজোড়কে এনে দাও। আমার কী অপরাধ ছিল? এভাবে কেন তাদের কেড়ে নিল আল্লাহ।’

এমশাদ ও মেহরাবের চাচা ব্যবসায়ী জমির হোসাইন বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর চরে দুই ভাইপোর জানাজা এবং সামাজিক কবরস্থানে দাফন শেষে বাড়িতে চলে আসি আমরা। এসেই দেখি আমাদের ভাবী (এমশাদ ও মেহরাবের মা) পুত্রদ্বয়ের বই–খাতা ঘাঁটছিল। এ সময় এমশাদের একটি খাতায় তার হাতের লেখা চিঠি পেয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠেন এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন দৌঁড়ে গিয়ে ভাবীকে উদ্ধার করতেই তাঁর হাতে পাই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার মতো সেই চিঠি। ওই চিঠি পড়ে আমরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।’

চকরিয়া গ্রামার স্কুল পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘পিইসি ও জেএসসির ফলাফলে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে বিদ্যালয়ের সুনাম বয়ে এনেছিল আমিনুল হোসাইন এমশাদ। দুই পরীক্ষায় সে বৃত্তিও পেয়েছিল। তার ছোট ভাই মেহরাব হোসাইনও পড়ালেখায় বেশ মেধাবী।’

তিনি আরো বলেন, ‘আগামী ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল এমশাদের। এজন্য বিদ্যালয়ের পাঠ নেওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরে একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারেও ভর্তি করে দেওয়া হয়। যাতে মেধার স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। কিন্তু মাতামুহুরী ট্রাজেডিতে এমশাদ–মেহরাবদের পরিবারের মতো আমাদের স্বপ্নও চুরমার হয়ে গেল। এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে যেন আর কারো মায়ের বুক খালি না হয় সেজন্য প্রার্থনা করি আল্লাহর দরবারে।’

প্রসঙ্গত–গত শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ও চকরিয়া পৌরশহর চিরিঙ্গা আনোয়ার হোসাইনের দুই পুত্র আমিনুল হোসাইন এমশাদ এবং অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন, দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও পৌরশহরের হাসপাতাল পাড়ার মো. শওকত আলীর পুত্র ফরহাদ বিন শওকত, চকরিয়া গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলামের পুত্র দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইয়্যিদ জাওয়াদ আর্ভি ও একই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জলি ভট্টাচার্য্য ও কঙবাজার সদরের ব্যবসায়ী কানু ভট্টাচার্য্যের পুত্র তুর্ণ ভট্টাচার্য্য মাতামুহুরীর চরে ফুটবল খেলা শেষে নদীতে স্নান করতে নেমে চোরাবালিতে আটকে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এরপর থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধার করা হয় নদীতে তল্লাশি চালিয়ে।

এমশাদের বাড়িতে জেলা প্রশাসক : এদিকে এমশাদ ও মেহরাবের বাবা–মাসহ পরিবার সদস্যদের সমবেদনা জানাতে চকরিয়া পৌরশহরের স্টেশন পাড়াস্থ তাদের বাড়িতে যান কঙবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। এ সময় তিনি দুই শিক্ষার্থীর বাবাসহ পরিবার সদস্যদের সমবেদনা জানান। গতকাল সোমবার রাত আটটার দিকে তিনি আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে যান। এ সময় ডিসির সাথে ছিলেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দীন আরাফাত, চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এছাড়াও টিআইবি সদস্য জিয়াউদ্দিন জিয়া, চকরিয়া প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক এম আর মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!