আন্তর্জাতিক ডেক্স : দু’দিন আগের ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিভিন্ন শহরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত মৃতদেহের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বৈরী আবহাওয়া ও বিপর্যয়ের ব্যাপকতার কারণে উদ্ধার তৎপরতায় বেগ পেতে হচ্ছে। ফলে শত শত ভবনের নিচে এখনও চাপা পড়ে আছে বহু মরদেহ, আটকা পড়ে আছেন অনেক জীবিত লোকজনও। তাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাদেরকে দ্রুত উদ্ধার না করলে ধংসস্তূপের মধ্যেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন। দুই দেশের উদ্ধারকর্মীরা অনুমান করতে পারছেন না— এখনও কত সংখ্যক মানুষ চাপা পড়ে আছেন ইট-পাথরের জঞ্জালের নিচে। সোমবারের আকস্মিক এই দুর্যোগের দু’দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনও প্রবল শোকের ধাক্কা থেকে বেরোতে পারছেন না দুই দেশের বাসিন্দারা।
তুরস্ক ও সিরিয়ার উদ্ধারকর্মীদের বরাত দিয়ে এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দু’দিনে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করা মৃতদেহের সংখ্যা ১১ হাজার ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। তুরস্কে ধসে পড়া বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তুপ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮ হাজার ৫৭৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন কর্মীরা। আর সিরিয়ায় উদ্ধার করা মরদেহের সংখ্যা ২ হাজার ৬৬২ জন ছাড়িয়ে গেছে।
সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও তার প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া। ওই ভূমিকম্পের ১৫ মিনিট পর ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্প এবং পরে আরও অনেকগুলো আফটারশক হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাহমানমারাস প্রদেশের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল।
জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস ইতোমধ্যে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, উদ্ধার তৎপরতায় আরও গতি না আনলে ধ্বংসস্তুপের নিচে এখনও যারা জীবিত অবস্থায় আটকা পড়ে আছেন, তাদের জীবনের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের খারমানমারাস শহরের বাসিন্দা মেসুত হানসেরের এই সতর্কবার্তায় আর উদ্বিগ্ন হওয়ার অবস্থায় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মেসুত হানসেরের একটি ছবি প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, হিমশীতল ঠান্ডার মধ্যে বসে আছেন তিনি, আর এক হাতে ধরে আছেন ধ্বংসস্তুপের মাঝে চাপা পড়ে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়া তার ১৫ বছরের মেয়ে ইরমাকের হাত।
অনেকেই তাকে নিরাপদ উষ্ণ জায়গায় সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু সেসব পরামর্শ কানে না তুলে তিনি জানিয়েছেন, মেয়ের দেহ উদ্ধারের আগ পর্যন্ত এ জায়গা থেকে নড়বেন না তিনি।
ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে লোকজন
ভূমিকম্পে যারা অক্ষত আছেন, তারাও পড়েছেন সীমাহীন ভোগান্তিতে। ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তারা আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল, মসজিদ এমনকি বাস স্টেশনগুলোতেও। আগুন জ্বালিয়ে কোনো প্রকারে ব্যাপক ঠান্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করছেন।
খারমানমারাস শহরের বাসিন্দা আলি সাগিরোগলু এএফপিকে বলেন, ‘আমার ভাই-ভাতিজা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাদের এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, কোথাও সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মী নেই।’
‘খোদার নামে শপথ করে বলছি, গত দু’দিনে আমরা সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ পাইনি। ঠাণ্ডায় লোকজন জমে যাচ্ছে, শিশুদের কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।’
ভূমিকম্পের এপিসেন্টার গাজিয়ানতেপে দোকানপাট সব বন্ধ আছে। বিস্ফোরণের ঝুঁকি এড়াতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। শহরটিতে পেট্রোলও দুর্লভ হয়ে উঠেছে।
তুরস্কের এক বিমানবন্দরে রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রিটিদের জন্য নির্দিষ্ট লাউঞ্জে মেঝের ওপর কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছেন প্রায় ১০০ জন দুর্গত মানুষ। জাহিদা সুটকু তাদের মধ্যে একজন। ভূমিকম্পে অ্যাপার্টমেন্টভবন ধসে পড়ায় নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
নিজের দুই শিশুকে দেখিয়ে এএফপিকে এই নারী বলেন, ‘অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ধসে যাওয়ার পর এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখন আমদের জীবন খুবই অনিশ্চিত। এখানে শিশুদের কীভাবে দেখাশোনা করব আমি?’
এদিকে, গত এক দশকের গৃহযুদ্ধের জেরে সিরিয়ার অনেক শহরে হাসপাতালসহ যাবতীয় অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূমিকম্পে দেশটির বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তুরস্কের তুলনায় তার প্রতিবেশী এই দেশটির বাসিন্দারা কয়েকগুণ বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন।
সিরিয়ার সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণাধীন শহর জিনদায়ারিসের একটি হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপ থেকে এক নবজাতককে উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। শিশুটির আত্মীয় খালিল আল সোয়াদি এএফপিকে বলেন, ‘উদ্ধারকারীরা কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেছেন। তার মা মারা গেছেন। আমরা ইতোমধ্যে তাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করেছি।’