ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার বা ছয় লেনে রূপান্তর কতদূর

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার বা ছয় লেনে রূপান্তর কতদূর

নিউজ ডেক্স : ব্যস্ততম চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি যেন নামেই মহাসড়ক। দুই লেনের এই মহাসড়কটি চার বা ছয় লেনে রূপান্তরিত হচ্ছে– এমন আশার বাণী দীর্ঘদিন ধরে শুধু শুনেই যাচ্ছে মানুষ। বার বার পিজিবিলিটি স্টাডি (সমীক্ষা) চালানো হলেও সড়কটির চার বা ছয় লেনে রূপান্তরে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এই অবস্থায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটিতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অসংখ্য মানুষ।

গত ২৭ মাসের (দুইবছর এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহাসড়কটির অন্তত শতাধিক অংশের বিপজ্জনক বাঁকে (মোড়) প্রায় ৪৮৭টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তদ্মধ্যে অত্যধিক বিপজ্জনক বাঁকে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৩৮ জন। আহত হয়েছেন হাজারের বেশি যাত্রী–সাধারণ। তদ্মধ্যে একেবারে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অসংখ্য যাত্রীকে।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে বছর ওয়ারী পরিসংখ্যা অনুযায়ী, ২০২০ সালে ২২৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৯ জন নারী–পুরুষ। আহত হয়েছেন ৫৫৮ জন। ২০২১ সালে ২৩৫টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২ জন এবং আহত হয়েছেন ৫৪০ জন। চলতি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২৬টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৭ জন। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি। তদ্মধ্যে অসংখ্য পর্যটকও রয়েছেন। হাইওয়ে পুলিশ, নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠন এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতির কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার এই মহাসড়কটির চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৫৭ কিলোমিটার। এই দূরত্বের সড়কটিতে বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে ৩১টি। মহাসড়কের চকরিয়া অংশের ৩৯ কিলোমিটার অংশে দুই পাশে রয়েছে ঝোঁপ–জঙ্গল। এ কারণে দূর থেকে সামনের বিপজ্জনক বাঁক সহজে বোঝা যায় না। এতে ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে পর্যটকবোঝাই যানবাহনগুলো নিমিষেই দুর্ঘটনায় পতিত হয়। গত ৮ মার্চ ভোরে চকরিয়ার মালুমঘাট এলাকায় পিকআপ চাপায় একই পরিবারের ছয় ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর সড়ক ও জনপথ বিভাগ বিপজ্জনক বাঁক ও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় দিকচিহ্ন ফলক ও সাইনবোর্ড স্থাপন, সড়কে বাতি প্রতিস্থাপনসহ দৃশ্যমান কিছু কাজ করে।

এসব উদ্যোগের পরেও দুর্ঘটনা না কমার পেছনে কয়েকটি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– প্রশিক্ষিত চালক না থাকা, অনুমোদন না থাকলেও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করা, নিষিদ্ধ করা হলেও সড়ক দাপিয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক– সিএনজিচালিত টেক্সির চলাচল। লবণবাহী ট্রাক পরিবহনসহ অনিয়ন্ত্রিত এসব যানবাহন চলাচল সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ সামলাতে না পারা, অবৈধ যানবাহনের বেপরোয়া গতিতে চলাচল করা, তদুপরি মহাসড়কের ওপরসহ দুই পাশে অবৈধ হাট–বাজার বসানো। এসব অনিয়ম ছাপিয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি ওয়ানওয়ে তথা চার লেন বা ছয় লেনে রূপান্তর না হওয়ায়।

প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার বাস–মিনিবাস পরিবহন শ্রমিক নেতা কামাল আজাদ বলেন, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বের এই মহাসড়কটি বর্তমানে একেবারে নামের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। সড়কটির পটিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সীমান্তবর্তী জাঙ্গালিয়ার ঢালা, আজিজনগর বাজার, হারবাংয়ের গয়ালমারা, হারবাং বাজার, হারবাং ইনানী রিসোর্ট, বানিয়ারছড়া, নলবিলা, ফাঁসিয়াখালী ভেণ্ডিবাজার, হাসেরদিঘী, মইগ্যারমারছড়া, মালুমঘাটের মাজার গেইট, ডুলাহাজারা বাজার, খুটাখালীর মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, নাপিতখালীসহ অন্তত অর্ধ শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে। এসব বাঁক ছাড়াও সড়কটির দুই পাশের প্রশস্ততা এতই সংকুচিত যে, প্রতিনিয়ত ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এছাড়া নিয়ম না মেনে লবণবাহী ট্রাক চলাচলকেও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলছেন এই পরিবহন শ্রমিক নেতা।

দুর্ঘটনাপ্রবণ চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ব্যস্ততম চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে যানবাহনের চাপ। সেই তুলনায় মহাসড়কটি যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না। তার ওপর বেপরোয়া গতির পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক ও প্রয়োজনীয় ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকায় একেবারেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে মহাসড়কটি। এটি নামে মহাসড়ক হলেও বাস্তবে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। এসব সমস্যার কারণে প্রতিনিয়ত বড় বড় দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছে বেশুমার মানুষ। তাই এই মহাসড়কটি চার লেন বা ছয় লেনে রূপান্তরিত যতদিন হবে না, ততদিন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেন বা ছয় লেনে রূপান্তরের বিষয়ে অগ্রগতি কতদূর জানতে চাওয়া হলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহে আরেফিন বলেন, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তবে সড়কটিকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সেই তৎপরতার আলোকে ইতোমধ্যে বাঁক সরলীকরণ, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক শনাক্ত করে সেখানে প্রয়োজনীয় দিক–নির্দেশনাসম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন, সড়ক বাতি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আরো কাজ চলমান রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, দেশের পর্যটন রাজধানীর গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেনে রূপান্তর করতে ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা প্রকল্প শুরু করা হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এই সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৫ সালে। পরবর্তীতে আরো একাধিক সংস্থা সড়কটি নিয়ে সমীক্ষা চালায়। কিন্তু এখনো সেই সমীক্ষাতেই আটকে আছে এই মহাসড়কের উন্নয়নকাজ। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুইডিশ কনসালট্যান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে ২২৫ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এটি ‘কন্ট্রোলড–এক্সেস হাইওয়ে’ হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করে সওজ। সেই পরিকল্পনায় মহাসড়কটির দৈর্ঘ্যও পরিবর্তিত হয় ১৩৬ কিলোমিটারে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় প্রাক্কলন করে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয় তখন। সেই নকশায় মহাসড়কটির প্রশস্ততা নির্ধারণ করা হয় ৮২ ফুট। নকশায় দুই পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন থাকার বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হয়। মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ৩১৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। কিন্তু বর্তমানে তা কেবল কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। -দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!