কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : ৩৬ থেকে ৩শ গেলে কত থাকে বাকি। এ যেন কালিদাশ পণ্ডিতের ধাঁধাঁর ফাঁকির মতো অবস্থা। এভাবে চলছে মিয়ানমারের নির্যাতিত, নিগৃহীত রোহিঙ্গাদের সেবার নামে অমানবিক বাণিজ্য। সরকারি ৮শ ২০ ফুটের একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের খরচ এক লাখ দশ হাজার টাকা। সেখানে এনজিও বা সেবা সংস্থাগুলো গভীর নলকূপ স্থাপন করছে প্রতিটি এক লাখ আশি হাজার থেকে দুই লাখ বিশ হাজার টাকায়। তাও আটশ বিশ ফুট গভীরে নলকূপ স্থাপন করার কথা থাকলেও করা হচ্ছে ত্রিশ থেকে ষাট ফুটের মধ্যে। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরগুলোতে ওয়াটার ও স্যানিটেশন বা ওয়াটসন কাজে ৪২টির মধ্যে এ ধরনের অনিয়ম ও পুকুর চুরি ঘটনার অভিযোগ অন্তত ১৭টি সেবা সংস্থার বিরুদ্ধে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোর অধিকাংশের অবস্থান পাহাড় ও টিলায় হওয়ায় তাছাড়া স্থানীয় পরিবেশ ও সুপেয় পানীয় জলের সহজ লভ্যতা বিবেচনা করে অগভীর নলকূপ স্থাপনের বদলে গভীর নলকূপ স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। প্রতিটি নলকূপের দূরত্ব ন্যূনতম ১শ মিটার বা সাড়ে তিনশ ফুটের বেশি দূরত্বে স্থাপনের নির্দেশনাও রয়েছে। সরকারী প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নলকূপগুলোর ১৩ প্যারামিটার পানি পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক রয়েছে। পক্ষান্তরে কাজের সুবিধাত্বে এনজিওগুলোর ক্ষেত্রে ৪টি অর্থ্যৎ আর্সেনিক, আয়রন, ক্লোরাইড ও ফিক্যাল কোলিও ফর্ম পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা আছে। পাইপ, পাম্প, ফিল্টার, পানি সহ অন্যান্য উপকরণ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা–নিরীক্ষা সাপেক্ষে স্থাপন করার নির্দেশনা রয়েছে।
সরেজমিনে উখিয়ার জামতলী, বালুখালী, কুতুপালং, তাজনিমার খোলা, মধুর ছড়া অস্থায়ী রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে দেখা গেছে, এনজিওগুলো পাহাড়, টিলার উপর গভীর নলকূপ স্থাপন করার কথা থাকলেও তা করছে না। নিজেদের সুবিধার্থে বরাদ্দকৃত অর্থ সাশ্রয় করে তা পকেটস্থ করতে পাহাড়ের ঢালুতে, সমতল ও নিচু এলাকায় একের পর এক নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। উখিয়ার হাকিম পাড়া, ময়নার ঘোনা, মধুর ছড়া, বালুখালী বিভিন্ন আশ্রয় শিবির যেখানে প্রতিটি নলকূপের দূরত্ব ন্যূনতম সাড়ে তিন’শ ফুট থাকার কথা সেখানে পনের বিশ ফুটের ব্যবধানে স্থাপন করা হয়েছে শত শত নলকূপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বেশ কয়েকজন ঠিকাদার ও নলকূপ মিস্ত্রী জানান, সংশ্লিষ্ট এনজিওর কর্মকর্তারা তাদের গভীর নলকূপে প্রতিটি চার’শ থেকে পাঁচ’শ ফুটের মধ্যে স্থাপন করতে মৌখিক ভাবে বলেছে। যদিও কার্যাদেশে প্রতিটি গভীর নলকূপের গভীরতা ৮শ ২০ ফুট ধরা আছে।
এ ক্ষেত্রে প্রকৃত স্থাপিত নলকূপের ক্ষেত্রে মোট বিলের পাঁচ শতাংশ ও চুরিকৃত নলকূপের চার শতাংশ, টিকাদার ও চল্লিশ শতাংশ সংশ্লিষ্ট এনজিওর কর্মকর্তারা ভাগ করে নেয়। যদিও কোন এনজিও কর্মকর্তারা এ সত্যতা শিকার করেনি। বিশেষ করে স্থাপিত নলকূপগুলোর পানির তের প্যারামিটার পানির পরীক্ষা–নিরীক্ষার স্থলে এনজিওগুলোর ক্ষেত্রে যে চারটি প্যারামিটার পরীক্ষা–নিরীক্ষার নির্দেশনা রয়েছে তাও তারা মানছে না। গুরুত্বপূর্ণ ক্লোরাইড ও ফিকেল কোলিইফর্ম ও অনেকেই পরীক্ষা করছে না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে নির্দেশনা অনুযায়ী স্থাপন সকল নলকূপ ও ল্যাট্রিন করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। ফলে পানি বাহিত ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত নানা রোগ ব্যাধির ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উখিয়া সহকারী প্রকৌশলী মো. ইকবাল হাসান বলেন, বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তি পর্যায়ের ইতোপূর্বে স্থাপিত প্রায় সাত হাজার অগভীর নলকূপের মধ্যে ৮০–৮৫ শতাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। স্বভাবতই পরীক্ষা করে দেখা গেছে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় বর্তমানে ২৮ ফুট পানির গভীরতা নিচে রয়েছে। সে অনুযায়ী সরকার ও অত্র বিভাগ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ৬শ মত গভীর নলকূপ স্থাপন করবে। ইতিমধ্যে ৮২টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এনজিও গুলো স্থাপন করেছে ৩৭২টির মত গভীর নলকূপ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থগুলোর ওয়াটসনের ক্ষেত্রে সরকারের কোন বিধি বিধান মানছে না এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাথে সমম্বয় করছে না। তদন্তে দেখা গেছে ৮শ ২০ফুট গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৬০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ স্থাপন করে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করার তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এগুলোকে দুর্ণীতি, অনিয়ম যেটাই বলি না কেন কোন পর্যায়ে পড়ে তা বলা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ওয়াটসন কাজের নিয়োজিত ৪২টি এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে ১৭টি এনজিও ও সংস্থার কাজে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাঠের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের জরুরি কার্যক্রম শেষ হলেও এনজিও কার্যক্রম সরকারের কঠোর নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।