ফিরোজা সামাদ : অাগামীকাল ভোর ছয়টায় লঞ্চ। রাতের খাবার শেষে গোছানো ব্যাগ, কাপড়- চোপড় অার একবার দেখে নেয় শুভ্রতা।।বরাবরই গোছানো ও শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। শুভ্রতার সাথে বড়ো তিন ভাই ও ছোট্ট দু’টি ভাই সহ মামা জলফু ঢাকা পর্যন্ত যাবে এবং এবারে শুভ্রতার চাচার।বাসায় উঠবে সে রকম ব্যবস্হাই হয়েছে ।
সবাই ঘুমুতে যাওয়ার পর শুভ্রতা মার কাছে গিয়ে বললো…

—- মা অামি তোমার কাছে অাজকে
শোবো ?
মা শাহানা বেগম মমতায় অার অজানা এক অাশঙ্কায় মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শুভ্রতা বলে ওঠে.
—- অাচ্ছা মা,অামি তো চলেই যাচ্ছি তাই যাওয়ার
অাগে বাবার সাথে অামি কিছু কথা বলতে চাই।
মা শাহানা বেগম অাস্তে বিছানা ছেড়ে স্বামীর ঘরে যান এবং ধীরে ধীরে ডাকেন
—- ঘুমিয়েছেন ?
—- কেনো ?
বোঝা গেলো, এনামুল হক সাহেবের চোখেও ঘুম নেই।
—- শুভ্র এসেছে, অাপনার কাছে।
এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন এনামূল হক সাহেব। যাওয়ার দিন যতো ঘনিয়ে অাসছিলো তিনি ততোই অাস্বস্হ হচ্ছিলেন, এই ভেবে যে, যাক কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো না। দু’টো মাস নিজেকে নিজে কঠিন করে রেখেছিলেন। স্ত্রীর কথায় ভাবলেন, অাজ বুঝি শেষ রক্ষা হলোনা। তারপরেও নিজেকে সামলিয়ে বললেন…
—- এসো,ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দাও।
শুভ্রতা বাবার কাছে খাটের উপর বসলো। মা শাহানা বেগম সামনে একটি বেতের মোড়ায় বসে পড়ে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। এনামুল হক সাহেবই প্রথম কথা বলেন….
—- কালকে চলে যাচ্ছো যাও, ভালোভাবে সংসার করো,
একটা কথা জানবে অামি যা করেছি অামার
সন্তানের ভালোর জন্যই করেছি । অারিফ খুব ভালো
ছেলে, নামকরা ডাক্তার, ও তোমায় সুখে রাখবে।
শুভ্রতা হঠাৎ বাঁধভাঙ্গা কান্নায় হাউমাউ করে কেঁদে বাবার কাঁধের উপর মুখ রেখে বলে….
—- কি এমন অন্যায় অামি করেছি যে অজানা,অচেনা
অপরিচিত একটা লোকের কাছে অামায় কোথায়
পাঠাচ্ছেন ? কি তার পরিচয় ? কোথায় ঘরবাড়ি, কে
তার বাবা-মা অাপনি কী জানেন ? অামার জানার
কোনো অধিকার কি নেই ?
—- হ্যাঁ, অামি তাকে জানি এবং চিনি।
শোনো তাহলে, অারিফের তিনকুলে কেউ নেই। ওর বাবা ছিলেন অামার বন্ধু । ১৯৬৮ সনে ওর মা বাবা দু’জন গুটি বসন্তে অাক্রান্ত হয়ে মারা যান।কচি ছোট্ট শিশুটিকে ওর মামা মামি নিজেদের মতো করে বড়ো করেছেন। ওর পৈত্রিক বাড়ি পিরোজপুর। মামাবাড়ি থানার রামনায় ডৌয়াতলা গ্রামে। মামা মামিও এখন বেঁচে নেই ।
তোমার কি অার কিছু জানার অাছে ?
শুভ্রতা কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে দাড়ালো এবং ধীরপায়ে বাবার কক্ষ থেকে বেড়িয়ে এলো । দৃঢ়ভঙ্গির হাটা দেখে মা শাহানা বেগম চমকে উঠে। হঠাৎ শাহানা বেগমের মনে হলো এই শুভ্রতাকে সে চেনেনা। পরদিন সকালে শুভ্রতা কোনো কান্নাকাটিই করলো না। ভাইদের বললো তোমরা এগোও অার মামা জলফুকে বললো তুমি অামার সাথে যাবে একটু অপেক্ষা করো। পাড়ার চেনা জানা কয়েকজন অাসলে তাদের কাছে সৌজন্য ক্ষমা চেয়ে বাবা মা’য়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে সোজা হেঁটে রিক্সায় বসলো। পাশে মামা জলফু। শেষবারের মতো শুধু একটিবার বাড়িটি অার মা’য়ের মুখটি দেখে নেয় শুভ্রতা, মায়ের চোখে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল ……( চলবে)