কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : কক্সবাজারের যত্রতত্র বসছে ‘রোহিঙ্গা বাজার’। গ্রাম থেকে শহর, সড়ক-মহাসড়ক, অলিগলি, গ্রাম্য হাটবাজার, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সর্বত্র যেন রোহিঙ্গা বাজার।
এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা সরকারের ট্রেড লাইসেন্স,আয়কর কিংবা এদেশের কোন প্রশাসনের অনুমতিও নিচ্ছেনা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, বাংলাদেশের আইনকানুন ব্যতি রেখেই হরদম চালিয়ে যাচ্ছে চোরাই পণ্যের ব্যবসা। আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকার বাহিনীর নিপীড়নের কথা বললেও মিয়ানমার থেকে সেদেশের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে ব্যবসায়িক যোগাযোগ রেখেই চলছে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমার বাহিনী ভাল। রোহিঙ্গা নিয়ে দুইমুখী ব্যবসা চলছে। রোহিঙ্গারা প্রাপ্ত ত্রাণের ব্যবসা চলছে ক্যাম্পের ভিতরে-বাইরে। তাতে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় সিন্ডিকেট জড়িত। আর মিয়ানমার থেকে মগসেনা,পুলিশ ও নাটালা মগদের সহায়তায় এপারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা চোরাই পথে নিয়ে আসছে মিয়ানমারের নানা পণ্যের চালান। এতে সীমান্ত এলাকার চিহ্নিত চোরাকারবারিদের ব্যবহার করছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা ও জানা গেছে, দেশি-বিদেশি নানা এনজিও বা ব্যক্তি বিশেষের দেওয়া ত্রাণ-সামগ্রী রোহিঙ্গারা বিক্রি করে দেয়। এগুলো দামেও সস্তা। ফলে এখানে ক্রেতার সংখ্যাও বেশি। আর বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্টির চাহিদা মেঠাতে মিয়ানমাররের চিহ্নিত চোরাকারবারিরা এপারে চলে আসলেও চোরাকারবার থেমে থাকেনি। আশ্রিত রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প, কুতুপালং বাজার, লম্বাশিয়া বাজার,বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১ /২ এর পানবাজার,ময়নারঘোনা,হাকিম পাড়া,গয়ালমারা,জামতলী প্রতিটি স্থানে অঘোষিত ভাবে গড়ে তুলেছে মিয়ানমারের চোরাই পণ্যের দোকান।শত- শত দোকান হয়ে ওঠেছে মিয়ানমারের নামকরা বাজার “বলিবাজার” যেটি বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১য়ে অবস্থিত।গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনা ও উগ্রপন্থী রাখাইনদের বর্বর নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৫ হাজার একর বনভূমিতে ২০টি ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেবা দিতে এগিয়ে আসে দেশের নানা প্রান্তের লোকজন। আসে বিদেশের অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি এনজিও। গেল বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের বর্ষণমুখর দিনগুলোতেও প্রতিদিন কয়েক শ’ যানবাহন নিয়ে সাহায্য-সামগ্রীসহ বিভিন্ন লোকজন ও প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসে। মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযানে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশি লোকজনসহ সরকারের মানবিক সহায়তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। সেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় থেকে এখনো বিভিন্ন ব্যক্তি-সংগঠন এবং এনজিওগুলোর তরফে অব্যাহত রয়েছে সাহায্য-সামগ্রী প্রদানের কাজ। প্রথমাবস্থায় অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রোহিঙ্গাদের মাঝে অনেক দামি কম্বল, রান্নাবান্নার সামগ্রী, নিত্যব্যবহার্য পণ্য দেওয়া হয়। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় চাল ও ডাল। ব্যক্তি বিশেষসহ বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেওয়া চাল-ডালের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রতিটি পরিবারেই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হয় চাল-ডাল।রোহিঙ্গারা দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ মেটাতে এসব পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে দেয়। স্থানীয় গ্রামবাসীই কিনে নেয় এসব পণ্য। প্রথম দিকে কেবল কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং এবং উখিয়া উপজেলা সদরের বাজারে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কিনে আনা পণ্যের কেনাকাটা শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকার লোকজনও ছুটে যায় সস্তায় ভালো পণ্য কিনে নেওয়ার জন্য। এ সময় ৪০ পিচের একটি ক্রোকারিজ সেট বিক্রি করা হয়েছে ৬/৭ শ টাকায়। একটি ভালো মানের কম্বল বিক্রি হয়েছে ২/৩ শ টাকায়। রোহিঙ্গাদের মাঝে এনজিওগুলোর তরফে বিতরণ করা হয় না এমন পণ্য বাকি নেই। রোহিঙ্গারা এমন সব হরেক পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্তও না। অনেকেই চেনে না এবং জানে না এসব পণ্য-সামগ্রী কিভাবে বা কেন ব্যবহার করা হয়। এ কারণে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক রোহিঙ্গা নারী বেজায় খুশিতে স্যাম্পুর বোতল পেয়ে বিদেশি সরিষার তেল ভেবে তরকারি রান্না করতে বসে। রোহিঙ্গা নারী দেখতে পায়, এক পর্যায়ে তরকারির ডেকচিতে ব্যাপক ফেনা হয়ে গেছে। তিনি খুশিতে তাৎক্ষণিক তার স্বামীকে ডেকে এনে ডেকচি দেখিয়ে বলেন, এই যে দেখ এক নম্বর তেল তাই এরকম ফেনা। রোহিঙ্গা শিবিরে বাস্তবে এরকম আরো অনেক কাহিনি রয়েছে।ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা বাজারের প্রসার ঘটতে শুরু করে। শহর আর গ্রামের লোকজন স্বল্প পুঁজিতে রোহিঙ্গাদের নিকট থেকে সস্তায় পণ্য কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজার আর স্টেশনে বসে বিক্রি করতে শুরু করে। রোহিঙ্গারা মসুর ডাল বলতে গেলে মোটেই খায় না। তাই তারা ১০০ টাকা কেজির ডাল বিক্রি করে দেয় ২০/৩০ টাকা কেজিতে। চাল বিক্রি করে দেয় কেজি ২৫/৩০ টাকা দরে। রোহিঙ্গা শিবিরে চাল-ডাল সরবরাহে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং এনজিওতে জড়িত লোকজনই এসব কিনে নিয়ে যায়। তারাই আবার এসব নতুন করে সরবরাহ দেয় রোহিঙ্গা শিবিরে। তখন এসবের দাম হয় তিন গুণ বেশি।রোহিঙ্গাদের পণ্যের বাজার ধীরে ধীরে উখিয়া-টেকনাফের বাজার ছাড়িয়ে কক্সবাজার জেলা শহরেও এসে পৌঁছে। শহরের প্রতিটি রাস্তা আর অলিগলিতেও এখন রোহিঙ্গা বাজারের পসরা বসে। বাস্তবে রোহিঙ্গা পণ্য সস্তায় মিলে-এরকম প্রচারকে পুঁজি করে এখন নকল পণ্য বিক্রেতারাই তাদের নকল পণ্য-সামগ্রী নিয়ে বসেছে অলিগলিতে। প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে শুরু করে, ক্রোকারিজ, টুথপেস্ট-ব্রাশ, পাউডার দুধ, চিনি, ডাল, স্যাভলন, ডেটল, প্লাস্টিক ত্রিপল, পাটি, বেডশিট, কম্বল, প্রসাধনী সামগ্রী এমনকি খেজুরও রোহিঙ্গা বাজারের পণ্য।রোহিঙ্গা বাজারের পণ্যের চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে নকল পণ্য এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের ছড়াছড়ি এসব বাজারে।মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের লেভেল তুলে ফেলে সেখানে নতুন করে লেভেল লাগিয়ে বিদেশি পণ্য হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের বেশির ভাগের বিশ্বাস হচ্ছে, বিদেশি এনজিওগুলো বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করেই রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করে থাকে। এসব পণ্যের দামও কম। বাস্তবে সাধারণ মানুষের এরকম মানসিকতার সুযোগটাই এখন নকলবাজরা নিচ্ছে।উখিয়ার দক্ষিণ স্টেশনে বসা রোহিঙ্গা বাজারের এক বিক্রেতার কাছে দেখা গেল-বেঙ্গল প্লাস্টিক কোম্পানির তৈরি ঢাকনা দেওয়া কয়েকটি বালতিতে লেভেল লাগানো রয়েছে অস্ট্রেলিয়া এইড। দাম হাঁকা হচ্ছে ১৬০ টাকা প্রতিটি। ক্রোকারিজ বক্সে লাগানো রয়েছে ইউএনএফপিএসহ আরো কয়েকটি বিদেশি সংস্থা ও এনজিওর নামের লেভেল। ক্রেতারা এসব লেভেল দেখেই মনে করছেন বিদেশি পণ্য। তাই দরদাম করে কিনছেনও বেশ।বাজারটির একজন ক্রেতা জানালেন, রোহিঙ্গা শিবিরে দেওয়া খেজুরও বিক্রি করা হচ্ছে একদম সস্তায়।
পরে বিক্রেতা জানালেন, আসলে এসব রোহিঙ্গা শিবিরের নয়, আনা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। বাজারটিতে ডেটল বিক্রি করা হচ্ছে অনেক দিনের পুরনো বোতলে করে। বিক্রেতা জানালেন, বোতল পুরনো হলেও মাল ভালো রয়েছে। উখিয়া উপজেলা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান এম.গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন,রোহিঙ্গাদের “মানবতার ব্যবসায়”সবকিছু হালাল।সেখানে দেশপ্রেম দেখিয়েও উল্টো মামলার হুমকি দেয়।আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই।তাই যেনতেন ভাবে চলবে উখিয়া-টেকনাফ