কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : মিয়ানমারের জোর পূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা হিন্দুরা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি, তবে নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত দাবী করেন। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা হিন্দু উদ্বাস্ত শিবিরে সরেজমিনে (২৯ ডিসেম্বর) গিয়ে হিন্দুদের সাথে কথা বলে জানা যায়। রোহিঙ্গা হিন্দুরের মাঝি শিশু চন্দ্র শীল জানান, তারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি। তবে আর কোন আত্মীয় স্বজনকে হারাতে চাননা। নিজেদের বসত বাড়ি ফেলে প্রাণ ভয়ে এপারে চলে আসলেও প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনে যেতে রাজি হন নিরাপত্তা নিয়ে। মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু থানার চিকনছরি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ সুরধন পাল (৬৫), সুভাষ রুদ্র (৬০), ইন্দ্র রুদ্র (৩৫), লীল মোহন শীল (৫০), চন্দ্র বালা (২০), লেডু শীল (৩২), জানান, তাদের বসত ভিটি, জায়গা জমি গরু ছাগল, দোকান পাট, ক্ষেত খামার সর্বস্ত্র হারিয়ে এপারে চলে আসছেন। স্বদেশে ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাড়ার কাছে থাকতে তারা নারাজ। হিন্দু রোহিঙ্গা মহিলা নমিকা বালা (৪৫) জানান, গত ২৫ আগষ্ট রাতের ঘটনার পর দিন দুপুর ২ টার সময় তার স্বামী নিরঞ্জন পাল নিখোঁজ হন। মুখোশধারী ২০/২৫ জনের একদল লোক তার স্বামীকে কোথায় নিয়ে গেলে এখনো অজানা। তিনি আরো জানান, তারা স্বামী- নিরঞ্জন পাল বেয়াইর বাড়ি শাহাব বাজারে বেড়াতে যান। দুপুরে বেয়াইর বাড়িতে ২০/২৫ জনের অজ্ঞাত মুখোশধারী দলবদ্ধ লোকজন বেয়াইর বাড়িতে স্বশস্ত্র হামলা করে স্বামী নিরঞ্জন (৫৫), কন্যা সন্ধ্যা বালা (২৫) কে হত্যা করা হয়। হত্যার সেই স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করছে। মিয়ানমারে ফিরে গেলে নিরাপদে থাকতে পারবে কিনা, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংকিত ললি মোহন বালা। সে আরো জানায়, তাদের কোন স্বজনকে হারাতে চান না। মিয়ানমার সরকার তাদের বসত বাড়ি ফিরিয়ে না দিলেও যেখানে আশ্রয় দেয় সেখানে যেতে রাজি, থাকতে রাজি। তবে নিরাপত্তা বাঁচাতে চান। কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা শিবিরের বকুল বালা (৪০) জানান, তার স্বামী- কানু রুদ্র (৫০) কে তার সামনে খুন করেছে মুখোশধারী লোকজন। তবে, তারা মগ সেনা নয়। তারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে মুসলমানদের পাড়া থেকে আলাদা করে থাকতে চান। কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা শিবিরের সাবেক মাঝি মধুরাম পাল (৬০) জানান, বর্তমানে কুতুপালংয়ে ৪৩৯ জন হিন্দু রোহিঙ্গা রয়েছেন ১শত পরিবারে। তারা একত্রে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান এবং নিরাপত্তায় বসবাস করার দাবী তুলেন। প্রসঙ্গত, আগামী বছরের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করবে মিয়ানমার। শুরুতে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু ধর্মালম্বীদের ফেরত নেয়া হবে।বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) এমন তথ্যই জানিয়েছেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আইয়ি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর হত্যা-ধর্ষণসহ সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাখাইনের সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। নিউ লাইটস অব মিয়ানমার এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিদোতে দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে পুনর্বাসনমন্ত্রী জানান, প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে ২২ জানুয়ারি সীমান্তে ৪৫০ হিন্দু শরণার্থীকে ফেরত নেয়া হবে।প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। প্রসঙ্গত, গত ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে, শুধু তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বিবেচনা করা হবে। এ প্রত্যাবাসন হবে কয়েকটি ধাপে।জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি এই সংস্থার ডেপুটি হাইকিমশনার কেলি ক্লেমেন্টস বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত নয়। এখনও শরণার্থীরা পালাচ্ছেন। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর হত্যা-ধর্ষণসহ সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এ ঘটনায় খুঁজে পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাখাইনের সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও।