নিউজ ডেক্স : বাহার উদ্দিন রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে ঢুকে পড়া একটি চড়ুই পাখিকে বাঁচাতে গিয়ে ঝলসে যায় তাঁর হাত ও পায়ের তালু। দীর্ঘ চিকিত্সার পর কেটে ফেলতে হয় দুই হাত। এভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান রায়হান। তবু পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হননি। মনোবল আর সাহস ছিল তাঁর সঙ্গী। হাত না থাকলেও মুখ দিয়ে লিখে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছেন। সর্বশেষ চকরিয়া কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন তিনি। জেএসসি ও এসএসসিতেও ভালো ফলাফল করেন। রায়হানের স্বপ্ন, পড়াশোনা শেষ করে একটি ভালো চাকরি।
রায়হানের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের জহিরপাড়ায়।

শিশু বয়সেই হারাতে হয় বাবা বশির আহমদকে। তাঁর আপনজন বলতে আছেন শুধুই মা খালেদা বেগম।
রায়হান বাড়িতে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছেন। সেখানে প্রতিমাসে ৪-৫ জনকে বেসিক কম্পিউটার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ওয়েবসাইট খোলা, অফিস ব্যবস্থাপনা, পাওয়ার পয়েন্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তাঁর পড়ালেখা আর সংসার। পাশাপাশি মাও বাড়িতে আয়বর্ধকমূলক কাজ করেন।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কাইছার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবাই মনে করেছিলেন দুই হাত হারানোর পর রায়হান আর পড়ালেখা করতে পারবে না। কিন্তু সেই ভাবনা দূরে ঠেলে সামনেই এগিয়েছে সে। সাহস ও উদ্যম থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই বাধা হতে পারে না, তা আরেকবার প্রমাণ করল রায়হান। ’
চকরিয়া আবাসিক মহিলা কলেজের প্রভাষক সুজন কান্তি নাথের কাছে দশম শ্রেণিতে ইংরেজি বিষয়ে পাঠ নেন রায়হান। সুজন নাথ বলেন, ‘পড়ালেখায় তার বেশ আগ্রহ রয়েছে। তার মাঝে অনেক প্রতিভা। দুই হাত না থাকার পরও সুযোগ পেলেই অনেক দূর যাবে সে। ’
স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চকরিয়ার সদস্য সাইদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘দুই হাত না থাকার পরও রায়হান পর পর তিন পাবলিক পরীক্ষায় যে কৃতিত্ব দেখিয়েছে তা অবিশ্বাস্য। শুধু তাই নয়, খেলাধুলাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত আছে সে। ইয়ুথ হাঙ্গারসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে। ’
রায়হানের সহপাঠীরা জানান, মুখ আর কনুইয়ের সহায়তায় লেখার চর্চা শুরু করেন রায়হান। কনুই দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টানো থেকে খাওয়া-দাওয়া, পড়া, মোবাইল ফোন ব্যবহার, কম্পিউটার চালানোসহ সব কাজই করতে পারেন তিনি। পাশাপাশি ভালো ফুটবলও খেলতে পারেন। কাজ করছেন মাদকের বিরুদ্ধে। সব ধরনের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সমাজসেবায় আর প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন রায়হান।
স্থানীয়রা জানান, রায়হান ছোটবেলা থেকেই দূরন্ত প্রকৃতির। ২০০৪ সালে বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমারে একটি চড়ুই পাখি আটকা পড়লে পাখিটিকে উদ্ধারে খুঁটিতে উঠে পড়ে রায়হান। এ সময় ট্রান্সফরমারটি বিস্ফোরিত হলে দুটি হাত ঝলসে যায়, পায়ের তালুও পুড়ে যায়।
বাহার উদ্দিন রায়হান বলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষার আগে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড থেকে আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয় অন্যের সহযোগিতা নিয়ে পরীক্ষা দিতে। অর্থাৎ আমার কাছ থেকে শুনে অন্যজন লিখবেন খাতায়। তখন আমি বলি, জেএসসি ও এসএসসি আমি নিজেই মুখ দিয়ে লিখে পাস করেছি। অতএব এবারও কারো সহায়তার প্রয়োজন পড়বে না। ’
রায়হান বলেন, ‘আমার এই জীবনসংগ্রামে চলার পথে মায়ের অবদানই বেশি। তাঁর কারণে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ’
এখন তাঁর স্বপ্ন লেখাপড়া শেষ করে একটি ভালো চাকরি করা। যদিও অভাবের সংসার, আছে নানা সমস্যা। এসব মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে চান রায়হান।
-কালের কণ্ঠ