( ১)
নাম কি?
-জ্বি,আমি ব্যাঙ মিঞা।
পড়ালেখা কতদুর?
-ডিগ্রি পাস।
কোথা থেকে পড়ালেখা করেছেন?
-জ্বি,আমি রহমতপুর ডিগ্রি কলেজ,ধর্মপাশা হতে লেখাপড়া করেছি স্যার।
ব্যাঙ মিঞার ছোটখাট একটা ক্ষমতা আছে সেটা হচ্ছে কেউ তাকে খুব সাধারণ ভেবে তাচ্ছিল্য করে কথা বললে লোকটার মনের মধ্যে কী খেলা করে তা সহজেই পড়ে ফেলতে পারা।এই মূহুর্তে ভাইভা বোর্ডের ঐ প্রশ্নকর্তা তাকে মনে মনে বলছে এত লোক থাকতে তোকে এই চাকরিতে নিয়োগ দেবার প্রশ্নই আসে না। না আছে ভাল লেখাপড়া,কেতাদুরস্ত ভাব আর না আছে কথাবার্তায় স্বতঃস্ফূর্ততা। আমাদের কোম্পানির প্রতি পদের বিপরীতে তোর থেকে শিক্ষায়-দীক্ষায় অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন কমপক্ষে ২০/৩০ জন ক্যান্ডিডেইট আবেদন করেছে তাই তোর মত তেল চিটচিটে, কালো আর অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোককে নিয়োগ দেয়ার কোন মানেই হয় না।
প্রশ্নকর্তা যথাসম্ভব অন্তরালের ভাবনাকে ঢেকে ফের প্রশ্ন করলেন-আচ্ছা বলতে পারেন আমারা আপনাকে কেন এই চাকরিতে নিয়োগ দেব?
-ব্যাঙ মিঞা মনের হতাশাটা কাটিয়ে একটু সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল।এটা আবার কি ধরণের প্রশ্ন।এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর কি হতে পারে সেটা ভাবতেই হঠাৎ করেই কারেন্ট এফেয়ার্সে পড়া একটি নমুনা ভাইভার এরকম প্রশ্নের উত্তরের কথা মনে পড়ে গেল। সে উত্তর দিল-স্যার আমি এ চাকরির জন্য যোগ্য, কারণ আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি।প্রতি মাসে চাকরির জন্য একটা টার্গেট ফিলাপ করতে হয়,যা আমি ঠিকমত ফিলাপ করতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস।
চাকরিটা হচ্ছে “কালা মিয়া ফুড প্রোফাক্টস এন্ড ফ্যাক্টরি লিঃ” নামে অখ্যাত লোকাল ফ্যাক্টরির আরএসএম(রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার)পদে, যার অধিকাংশ টার্গেটেড কাস্টমার হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।যারা গ্রামের দোকানে গিয়ে কোন ব্র্যান্ড না দেখেই বিস্কিট,পাউরুটি,চানাচুর,গুড়াসাবান ইত্যাদি ক্রয় করে।বেতন মোটামোটি পনের হাজার টাকার মত, টিএ ডিএ বিল বাদে।
ভাইভা শেষ করে বের হয়ে চাকরিটা হবে না নিশ্চিত জেনে ব্যাঙ মিঞা বিষণ্ণ মনে হেঁটেই মেসে ফিরছিল।হঠাৎ করেই তার পকেটের ফোনটা ভোঁ-ভোঁ করে কেঁপে ওঠল; ভাইভার জন্য রিংটোন অফ করে ভাইব্রশান দিয়ে রেখেছিল,সেকেন্ডহ্যান্ড ফোন,ময়না ভাইয়ের দোকান থেকে ছয়শ টাকা দিয়ে কেনা। রমিজ ভাইয়ের কল।
স্লামালিকুম রমিজ ভাই।
-ওয়ালাইকুম আসলাম।মিঞা ভাই আজকে কিন্তু মেসের ভাড়া দেওয়ার লাস্ট ডেট। আপনের ভাড়াটার জন্য পুরো মেসের ভাড়াটা দিতে পারতেসি না। ভাই, আজকের মধ্যে একটু কষ্ট করে ম্যানেজ করে দিয়ে দিয়েন।মালিক কিন্তু আজকেও আসছিল।
ব্যাঙ মিঞার পকেটে আছে মোটে বারো টাকা।অনেকদিন খাব খাব করেও অত্যধিক দামের কারণে বেনসন খাওয়া হয় না।আজকে আর এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।বারো টাকা দিয়ে একটা বেনসন সিগারেট ধরিয়ে সে হেঁটে চলছে ব্যস্ত শহরের গাড়ি-ঘোড়ার বিকট শব্দ আর মানুষের কোলাহল মাড়িয়ে;সবকিছুর মধ্যে থেকেও একজন নিঃসঙ্গ পথচারীর মত। এই কপর্দকশূণ্য অবস্থায় সিগারেটের ফিলিংসটাই অন্যরকম।শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে।প্রতি টানে সে সুদূর অতীতে ফিরে যাচ্ছে।তার স্পষ্ট মনে পড়ছে সেই ছোট্টবেলার উঠানের কোনে নিমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে কবিতা আওড়াতে আওড়াতে চানাচুর খাওয়ার দৃশ্য-
“চুপি চুপি খাও তুমি চানাচুর ভাজা
দুষ্টের শিরোমনি লঙ্কার রাজা।”
এরই মধ্যে আবার ফোনটা বেজে ওঠল।হঠাৎ করে সে আবার বাস্তবে ফিরে আসে।গ্রাম থেকে মা ফোন দিয়েছে। সমিতির কিস্তির টাকা পাঠাতে হবে।নাহলে সমিতিওয়ালারা বাড়ির গাভীটা নিয়ে যাবে।
এই শেষ বৈশাখের প্রখর রোদে ক্লান্তিহীনভাবে হেঁটে চলেছে ব্যাঙ মিঞা। পেপারে পড়েছিল এই উত্তাপকে গ্রাস করে পাহাড়সম শীতল বাতাস নিয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করতে নাকি আসছে ঘূর্ণিঝর “ফেনী”। এগুতে এগুতে একটুখানি শীতল বাতাসের আশায় আকাশের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় একখণ্ড মেঘ সূর্যটাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলছে।বিকেল চারটে।চারদিকটা হালকা অন্ধকার হয়ে আসছে।একটু পরেই আকাশ ছিদ্র করে বৃষ্টি নামবে; ব্যাঙ মিঞা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে চলছে।চলতে চলতে হঠাৎ সে নিজেকে আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ একটা অচেনা গলিতে,গলির শেষ প্রান্তের একটু আগে বাঁদিকে করে একটা মস্ত বড় মাঠ।মাঠে প্রচুর কুনো ব্যাঙ সমানে ডেকে যাচ্ছে একফোঁটা বৃষ্টির আশায়।
জনমানবহীন এই গলিতে কোনদিন এসেছে বলে ব্যাঙ মিঞার মনে হচ্ছে না। ফোনটা বের করে রমিজ ভাইকে কল করতে গিয়ে সে দেখতে পায় ব্যালেন্স শূণ্য। আর কোনকিছু চিন্তা না করে অজানা গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় সে।প্রচন্ড গরমকে নিমিষেই পরাস্ত করে দ্রুতগতির শীতল বাতাসের সাথে আকাশের বিজলী চমকিয়ে আকাশের বুক চিড়ে বৃষ্টি নামে। ব্যাঙ মিঞা মাঠের মধ্যে ব্যাঙেদের ঘ্যাঙর ঘ্যাং শব্দে সম্মোহিত হয়ে যায়।তারও এখন ব্যাঙ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার পুরো শরীর ভিজিয়ে সমস্ত ক্লান্তিকে মুছে নিয়ে যাচ্ছে।আশ্চর্যরকমের এক ভাললাগায় নিজের শরীরটাকে পুরো ছেড়ে দিয়ে মাটিতে ঘাসের উপর বসে পড়ল সে।চাকরি,রমিজ ভাই,মেসের ভাড়া,মা,কিস্তির টাকা…. সবকিছু তার স্মৃতি থেকে ধীরে-ধীরে মুছে যাচ্ছে।কাছেই একটা মস্ত বড় ব্যাঙ মহানন্দে ডেকে চলছে।ব্যাঙ মিয়া আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করছে তার শরীর আস্তে আস্তে ব্যাঙের শরীরে রুপান্তরিত হচ্ছে।তার হাত দুটো,পা দুটো অবিকল ব্যাঙের পায়ের মতন হয়ে যাচ্ছে।এই বিপদের কথা রমিজ ভাইকে জানাবে সেই ফুসরতও নেই,কারণ মোবাইলে ব্যালেন্স শূণ্য। সে নিয়তিকে মেনে নিয়েই পুরোটা ব্যাঙে রুপান্তরিত হয়ে ঝুম বৃষ্টি আর আকাশের বিজলী উপভোগ করতে করেতে ব্যাঙেদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে,এই মূহুর্তে ব্যাঙ মিঞা এত ভাল বোধ করছে যে সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ(ব্যাঙ)।
( ২)
পরেরদিন যেন কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব নিয়ে সূর্যটা ব্যাপক তেজ ছড়াচ্ছে।সকাল সাড়ে দশটা।রমিজ আলী পেপারটা হাতে নিয়ে গতকাল ঘূর্ণিঝরের খবর পড়ছেন। পত্রিকার প্রথম পাতাতে বেশ বড় করেই ছাপা হয়েছে।দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘূর্ণিঝর “ফেনী”র আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জেলা প্রশাসনসহ সকল দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একযোগে দূর্যোগ মোকাবেলার আহবান জানিয়েছেন এবং যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন।
রমিজ আলী তার দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পেয়ে দরজা খুলে দেন।মেসের ছোটভাই তরিকুল বেশ হাসিমুখে রমিজের হাতে একটা খাম ধরিয়ে বলে-রমিজ ভাই এখন থেকে আর বাসা ভাড়া নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না।আপনার একটা চাকরির এপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে।রমিজ আলী তড়িঘড়ি করে সেটা হাতে নিয়ে দেখেন-প্রাপকঃ রমিজ আলী
পিতা : লিয়াকত আলী
বর্তমান ঠিকানা : কালাশীল ৩২/৭, টিলাগড়, সিলেট।
কালামিয়া ফুড প্রোডাক্টস এন্ড ফ্যাক্টরি লিঃ এ তাকে আরএসএম পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।আগামী সাত দিনের মধ্যে জয়েন করতে বলা হয়েছে।নিয়োগপত্রটা ভালভাবে আবার পড়ার পর দেখলেন নাম-ঠিকানা তো সবই ঠিক আছে।কিন্তু,রমিজ আলী কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তিনি কবে এই চাকুরিতে আবেদন করেছিলেন এবং কবেইবা ভাইভা দিয়েছিলেন।
লেখক : পদ্মাসন সিংহ, সহকারী কমিশনার (ভূমি), লোহাগাড়া উপজেলা, চট্টগ্রাম।