Home | শীর্ষ সংবাদ | গল্প নয় কাহিনী

গল্প নয় কাহিনী

174

ফিরোজা সামাদ : আয়িশারা চার বোন। প্রত্যেক বোন দেখতে অসম্ভব সুন্দরী। কাছে বসে দেখলে মনে হয় ‘চকোরী’ ছবির নায়িকা সেই ছোট্ট শাবানাকে দেখছি। তবে শাবানার চোখ ছোট আর চার বোনের চোখ যেন টানা টানা কাজলনয়না। গায়ের রঙ দুধে হলুদের মিশ্রণ। জোড়া ভ্রু, গোলাপ পাপড়ি ভেজা ঠোঁট। এহেন রূপের অধিকারিণীরা আবার মেধা ও মননে সবার সামনে। স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে বেশ পরিচিত। গুণেও সবার সামনে। বড় বোন রাইসা লেটার নিয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম শ্রেণি হাতে নিয়ে সাথে সাথেই শিক্ষা বিসিএস দিয়ে শিক্ষকতার মহান পেশাটি বেছে নিলো। সাথে সাথে ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথেই বৈবাহিক গাঁটছড়া বাঁধলো। এ যেন পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার নিয়ে গেল সুন্দরী রাজকুমারীকে। সুয়োরানী হয়ে সামলাচ্ছে তার সাজানো সংসার। রয়ে গেল মেঝ রাজকুমারী।

মেঝ রাজকুমারী আয়িশা। রূপে গুণে শিক্ষায় বড়কে আরো একধাপ ছাড়িয়ে গেল। আয়িশা লেখাপড়ায় ক্লাসে তুখোড় ছাত্রী। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম স্থানটি কেড়ে নিয়ে এসএসসিতে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনার সময় ভাগ্য বিড়ম্বনা করলো আয়িশার সঙ্গে। ওর এত সাফল্য রূপ আকৃষ্ট করলো সম্পর্কে না যাওয়া দেখতে সুন্দর এক যুবক আত্মীয় শাহীনকে। জড়িয়ে পড়লো অসম প্রেমে। এর বেলায় বোধহয় দুয়োরানী শব্দটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। যুক্ত হতে থাকলো ‘অতি সুন্দরী না পায় বর আর অতি ঘরণী না পায় ঘর!’ ওদের এই প্রেম মা-বাবা আত্মীয়স্বজন কেউ মেনে নিতে পারলো না। একদিন ওরা দুজন কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ে করে সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলো। চোখের জলের বিনিময় যে সুখী হওয়া যায় না আমাদের দুয়োরানী তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিলো।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুয়োরানী আয়িশা মা হতে চললো। ব্রজমোহন কলেজে পড়া চুকিয়ে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে মাঝে মাঝে ক্লাস করতে থাকলো। কলেজ, শ্বশুরঘর, স্বামীর দেখভাল করা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হলো। অপরদিকে প্রেগনেন্সির কারণে নিজের শরীরটাও খুব দুর্বল লাগছিল আয়িশার। যখন এমন কষ্টকর অবস্থা, একদিন লুকিয়ে দ্বারস্থ হলো ওদের পারিবারিক পুরনো ভৃত্যের। তার একটি কিশোরী মেয়েকে কাজে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানালো। পুরনো ভৃত্য কোনো বাক্যব্যয় না করে তার মেয়ে মুকুলীকে দিয়ে গেল আয়িশার কাছে। মেয়েটি ভালোই দেখাশোনা করতে থাকে। রাতে মেয়েটিকে আয়িশা নিজে পড়ায়। ভাবে একটি মেয়ে যদি দারিদ্র্যকে জয় করে নিজের একটা সম্মানজনক পরিচিতি বানিয়ে নিতে পারে, ক্ষতি কী?
যথাসময় আয়িশার কোলজুড়ে ফুটফুটে আরেক রাজকুমারের আবির্ভাব হলো।

কিন্তু নানা-নানির কোনো আদর আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। আয়িশার স্বামী বেকার। বাধ্য হয়ে নিজের ও সন্তানের ব্যয় মেটানোর জন্য বাড়িতেই বেশ কয়েকটি মেয়েকে টিউশনি পড়াতে থাকলো। তাতে করে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতে থাকে। আয়িশা স্বামী শাহীনকে উৎসাহ জোগাতে থাকে কোনো কাজের জন্য। কিন্তু অলসতা যেন তার জীবনের ব্রত। এমনি পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে প্রেমের খেসারত দিয়ে যাচ্ছিল আয়িশা। এদিকে পড়ার চাপ বেড়ে গেল। সামনে অনার্স ফাইনাল। তবুও টিউশনি ছাড়ছে না। ওটা ছাড়লে চলবে কী করে? দেখতে দেখতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আয়িশা ছেলেকে মুকুলী ও শাশুড়ির কাছে রেখে সকালে পরীক্ষা দিতে যায়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই একদিন বাসায় ফিরে দেখে মুকুলীকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খোঁজখবর করছে। ওর বাবার কাছে মোবাইল করে জানতে পারে ওখানেও যায়নি। মহাবিপদে পড়লো গোটা পরিবার। স্বামীকে পাঠালো জানাশোনা কোথাও খোঁজখবর নিতে। কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল কিনা এমন সব ভাবতে ভাবতে দুদিন পর শাহীন মুকুলীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলো। সবার প্রশ্ন কোথায় গিয়েছিল মুকুলী? কোথায় পেলে? ইত্যাদি। কিন্তু শাহীন কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রুমের ভেতর চলে গেল। মুকুলী ওড়নার আঁচলের এক কোণা মুখে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আয়িশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, সাঁই সাঁই করে দুটো চড় কষিয়ে দিল গালে। সাথে সাথে ফুঁসে উঠলো মুকুলী, ‘খবরদার! আর একটা চড়ও দিবে না আমায়। এবার আপনি থেকে তুমিতে চলে গেল, তোমার এই সংসারে যে অধিকার, আমারও সেই একই অধিকার!’ আয়িশা স্তব্ধ হয়ে গেল। ধীরগতিতে রুমে ঢুকে শাহীনের সামনে দাঁড়ালো। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মুকুলী কী বলছে? কেন বলছে? এর জবাব দাও!’

শাহীন নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয়, ‘তুমি তো একজন নারী বুঝতে পারছো না? মুকুলী ঠিকই বলেছে। আমি মুকুলীকে ভালোবাসি। আয়িশার চোখে তিনটি বছরের ফেলে আসা অপমান, ব্যথা ও যাতনার দিনগুলো দ্রুতগতিতে ভেসে উঠলো আর মিলিয়ে গেল। চারপাশে শুধু ধু ধু মরুভূমি দেখতে থাকে। কোথায় যাবে আয়িশা ছেলেকে নিয়ে? মা-বাবা কি এই মুহূর্তে ওর পাশে থাকবে? হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শাহীনের মুখোমুখি হয়। তারপর শ্বশুর-শাশুড়ির সামনেই শাহীনকেও শক্ত হাতে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভালোবাসা? আরে ভালোবাসার তুই কী বুঝিস? তুই তো আস্ত একটা চরিত্রহীন কাপুরুষ!’ এই বলে এক কাপড়ে ছেলের জামাকাপড় নিয়ে বের হয়ে আসে।

আয়িশার দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে। কোথায় যাবে? কার কাছে গিয়ে দুচোখের অশ্রু ঝরাবে। শ্বশুর-শাশুড়ি অবশ্য আয়িশার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু আয়িশা নির্বিকার। চোখ দুটো জ্বালা করছে। কাঁদতে পারলে হয়তো একটু শান্ত হতো। কান্নারা কোথায় পালালো এই মুহূর্তে? ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিল। রাতটা কাটতে না কাটতেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বড় খালার বাসায় গিয়ে উঠলো। সেখান থেকেই এত প্রতিকূলতার মধ্যে পরীক্ষা শেষ করলো। আর টিউশনি চালিয়ে মা ও ছেলে জীবনযাপন করতে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল পেল। তাতে আয়িশা সর্বপ্রথম। যথারীতি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে যোগদান করলো। স্বামী পরিত্যক্ত ও বয়স বিবেচনায় নিয়োগ কমিটি ওকে শহরের মধ্যেই একটি স্কুলে সহশিক্ষিকা পদে নিয়োজিত করলো।

আয়িশা খালার বাসায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে একদিকে চাকরি অন্যদিকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকলো। পাশাপাশি বিসিএস গাইড কিনে নিয়মিত পড়তে থাকে। অনার্সের ফল বেরুলো প্রথম বিভাগে প্রথম। আশার আলো চোখের তারায় চিকচিক করে উঠলো।

পূর্ণ উদ্যমে আবার পড়াশুনা শুরু করলো আয়িশা। এবারে মাস্টার্স। তাতেও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলো। মাঝখানে বিসিএস (ক্যাডার) প্রিলিমিনারি দিয়ে লিখিত পরীক্ষার দিন গুনছে আয়িশা।

আয়িশার চোখে রাতে ঘুম নেই। জেগে জেগে আগামী সফলতার স্বপ্নে বিভোর থাকে আর দিনে তার সংগ্রাম চলে। সুন্দরী রূপসী সেই আয়িশাকে আর চেনা যায় না। গায়ের রঙ মলিন, মুখের হাসি বিলীন, পেটে ক্ষুধা, সমাজের কাছে লজ্জার জবাবদিহিতা করতে করতে যখন ক্লান্ত ঠিক সেই সময় বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হাজির। প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসে ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিল। আয়িশার মনে হলো ঈশ্বর স্বয়ং ওর কলমটা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র যেন ওর কতদিনের জানাশোনা। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আয়িশার মনে হলো নতুন এক সূর্য পুব আকাশ রাঙিয়ে উঁকি দিচ্ছে শুধু ওরই জন্য।

আজ সাত বছর হয়ে গেল আয়িশা ১ম শ্রেণির একজন বিসিএসের (প্রশাসন) কর্মকর্তা। সে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদমর্যাদায় চাকরি করছে সাফল্যের সাথে। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার, আরডিসি, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব পালন করে সচিবালয়ে কর্মরত আছে। এখন বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই প্রশংসায় মুখর আয়িশার। সবাই খোঁজখবর রাখছে।

এদিকে শাহীনকে ছেড়ে মুকুলী চলে গেছে এক রিকশাওয়ালার হাত ধরে। ওখানে বিয়ে করেছে। শাহীন বাবা-মাকে নিয়ে গিয়েছিল আয়িশার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু আয়িশা তার প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্তে অটল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে শাহীন ও শ্বশুর-শাশুড়িকে। আয়িশার ছেলে রাকিন ঢাকার নামকরা একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

আয়িশা এখন রূপে, গুণে, সাফল্যে সমাজে উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ছয় মাস আগে অফিসের সিনিয়র যারা, সবাই মিলে আয়িশার বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের পাত্র যদিও বিপত্নীক। প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তিন বছর আগে স্ত্রী মারা যান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আয়িশার ছেলের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তিনি নিজেও বিসিএসের (প্রশাসন) যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। সবদিক বিবেচনায় এই বিয়েকে স্বাগত জানান সর্বস্তরের মানুষ।

শিক্ষণীয় : নারী শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষার ফল খুবই মধুর। নারী সন্তানের জন্য ধৈর্য ও আত্মত্যাগের প্রতীক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!