নিউজ ডেক্স : ডা. মাজেদুর রহমান গত বছরের ৪ অক্টোবর যোগ দেন নেত্রকোনার মদন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে। তখন মাত্র একদিন অফিস করেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় ১৬ অক্টোবর মাত্র একদিন উপস্থিত ছিলেন কর্মস্থলে। এর পর আর কাজে ফেরেননি এ চিকিৎসক। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে জেলা সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ জানেন না। ওই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯ পদের বিপরীতে নয় চিকিৎসকের পদায়ন হয়েছে; কিন্তু কর্মস্থলে যান না তাদের কেউ। মেডিকেল অফিসার নাফিজ ইমতাজ একাই সামলাচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
নাফিজ ইমতাজ জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ইনডোরসহ সবকিছুই তাকে সামাল দিয়ে হয়। এতে রোগীর সেবা নিশ্চিত করা কঠিন। হাসপাতালের শূন্য পদগুলো পূরণ হলে এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা কাজে যোগ দিলেই সম্ভব রোগীর সেবা নিশ্চিত করা।
অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে জানতে ডা. মাজেদুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘ডিপার্টমেন্টাল একটু সমস্যা আছে, তাই কাজে যাচ্ছি না’। কী ধরনের সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব সমস্যা কী বলা যায়?’ এর পর তিনি ফোন কেটে দেন।
শুধু নেত্রকোনার মদন উপজেলা নয়, সারাদেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসক অনুপস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করছে। সরকারি হিসাবেই ৬০ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। তবে ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা গেছে, ৫৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত। কোনো কোনো উপজেলা একজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে। আবার কোনো উপজেলায় বাই রোটেশনে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলায় পদায়ন করা হলেও উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে অনেকে প্রেষণে অথবা সংযুক্তি নিয়ে পছন্দমতো কর্মস্থলে চলে যান। আবার অনেকে অনুমতি ছাড়াই বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও ফাঁকা পড়ে আছে।
এ পরিস্থিতিতে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপজেলায় চিকিৎসক অনুপস্থিতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপজেলায় থাকতে না চাইলে তিনি চিকিসকদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ারও আহ্বান জানান; কিন্তু এতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
অনুপস্থিতির চিত্র : সমকাল সম্প্রতি ১০ জেলার সদর হাসপাতালগুলোয় এবং ৮১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখতে পেয়েছে, নির্ধারিত পদের বিপরীতে মাত্র ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে রয়েছেন। তবে সরকারি হিসাবে পদায়নকৃত চিকিৎসকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কর্মস্থলে উপস্থিত থাকছেন না।
পটুয়াখালী জেলা সদর হাসপাতাল ও পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভোলা জেলা সদর ও ছয়টি উপজেলা, বরগুনা জেলা সদর ও পাঁচটি উপজেলা, নোয়াখালী সদর ও নয়টি উপজেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা সদর ও ১২টি উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলা সদর ও ১১টি উপজেলা, নেত্রকোনা জেলা সদর ও ১০টি উপজেলা, রাঙামাটি জেলা সদর ও নয়টি উপজেলা, বান্দরবান জেলা সদর ও সাতটি উপজেলা, খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতাল ও সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরেজমিন পরিদর্শন করে চিকিৎসক অনুপস্থিতির ভয়াবহ চিত্র দেখতে পেয়েছে সমকাল। এসব জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই হাজার ২৪ পদের বিপরীতে মাত্র ৯১০ জন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে। এ হিসাবে নির্ধারিত পদের বিপরীতে মাত্র ৪৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ চিকিৎসককে জেলা ও উপজেলায় পদায়ন করতে সরকার সক্ষম হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০০ জন প্রেষণ নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন এবং ৩৪ জন যোগ দিয়ে আর কর্মস্থলে ফেরেননি। এ হিসাবে মাত্র ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে রয়েছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। গত বছরের ১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত এক মাসের হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। আট বিভাগের আওতায় সরকারি ৪৭০টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ওই পর্যালোচনা অনুযায়ী জুলাই মাসে তাদের উপস্থিতির হার ছিল ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ। সর্বোচ্চ খুলনায় ৪৭ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ময়মনসিংহে ৩১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তবে অবাক করার মতো তথ্য হলো, ঢাকা বিভাগেও চিকিৎসকদের উপস্থিতির হার সন্তোষজনক নয়। ঢাকায় এ হার মাত্র ৪২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর পর পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রামে ৩৭ দশমিক ৪০, রংপুরে ৪০ দশমিক ৬১, রাজশাহীতে ৪০ দশমিক ৯০, বরিশালে ৪১ দশমিক ৯২ এবং সিলেটে ৪২ দশমিক ৯১ শতাংশ চিকিৎসক উপস্থিত থাকছেন।
কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে। উপসচিব খলিলুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অধিদপ্তরকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
মনিটর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের মে ও জুনের তুলনায় জুলাই মাসে উপস্থিতি কমেছে। এ বিষয়টিকে চিঠিতে ‘হতাশাজনক’ বলা হয়। চিকিৎসকসহ অন্য সেবাকর্মীদের অনুপস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যসেবায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছে জানিয়ে চিঠিতে সব বিভাগীয় পরিচালককে সমস্যা সমাধানের উপায়সহ ব্যাখ্যা তলব করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে অন্তত পাঁচজন সিভিল সার্জন বলেন, কর্মস্থলে চিকিৎসক অনুপস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সংকট দূর করার আবেদন জানিয়ে প্রতি মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়; কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম মুজাহারুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগে পদের তুলনায় চিকিৎসক কিছুটা কম রয়েছে। সংকট দূর করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত চিকিৎসকদের উপজেলায় পদায়ন করা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই তারা উচ্চপর্যায়ে লবিং-তদবির করে ফের সুবিধাজনক জায়গায় চলে আসেন। এতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তদারকি করা হয়। এ হিসাব ধরে উপস্থিতি পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কারণ কাউকে বদলি করা হলে আগের ও বর্তমান কর্মস্থলের হিসাব নিরূপণ করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। এ কারণে অনেকে হাজিরা দিতে পারেন না। মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক উপস্থিত রাখা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করে মহাপরিচালক বলেন, গ্রামে চিকিৎসক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকদের প্রণোদনার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। নিয়মিত বাই রোটেশনে পদায়ন করা হবে। তখন সমস্যা কেটে যাবে।
ঢাকায় এখনও দুই শতাধিক ওএসডি পোস্টিং : গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ১১০ চিকিৎসককে একযোগে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বদলি করা হয়। অথচ বেশিরভাগ চিকিৎসকই নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন চিকিৎসকের বদলির আদেশ প্রত্যাহার করতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা নমনীয় হয়েছে। তাদের বাইরে এখনও ওএসডি পোস্টিং নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দুই শতাধিক চিকিৎসক অবস্থান করছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর চার হাসপাতালেই ১৪০ জন চিকিৎসক এখনও ওএসডি পোস্টিং নিয়ে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও হাসপাতালে ৪৮, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৩৮, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ২২, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৩২ জন চিকিৎসক রয়েছেন। অন্যরা মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, নিটোর, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অবস্থান করছেন।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে কোনো হাসপাতালে সংযুক্তি পদায়ন থাকবে না। খুব শিগগির এটি বাতিল করা হবে। কর্মস্থলে অনুপস্থিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি। -সমকাল