নিউজ ডেক্স : স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে জটিলতা কেটেছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে একনেকে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্প নিয়ে গত আড়াই বছর ধরে নানা কথা শোনা গেলেও গত ডিসেম্বরে চীনা ব্যাংক ১১শ’ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে। নদীর তলদেশে মূল কাজের জন্য টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এটি বাংলাদেশে পৌঁছার পর শুরু হবে মূল কাজ। তবে নদী গর্ভে মূল কাজ শুরু করতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্ণফুলী টানেলের উপ-প্রকল্প পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) ড. অনুপম কুমার সাহা সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা ঘুরে গেছেন। তিনি বলেন, টানেল একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। নদীতে বোরিং শুরু করাটাই সব নয়। তার আগে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। সেগুলো শেষ পর্যায়ে আছে। টানেলের অতি জরুরি ইক্যুপমেন্ট হচ্ছে ‘টানেল বোরিং মেশিন’। যেটি মাস দুয়েকের মধ্যে এসে পৌঁছবে। অর্থ ছাড়ও হয়ে গেছে। এখন টানেলের কাজ বেশ ভালভাবেই এগোচ্ছে ।
সূত্র জানায়, ঋণচুক্তি অনুযায়ী চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে প্রথম দফায় ১৪১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া গেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ১১০৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এ টাকা ঠিকাদারী সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে (সিসিসিসি) বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় তিন দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল ছাড়াও পূর্ব প্রান্তে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ও পশ্চিম প্রান্তে ৭৪০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা চীনের। বাকি অর্থ সরকারি তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে। এবাবদ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) এ প্রকল্পে ১ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, চীনের ঋণে দুই শতাংশ সুদ হার ছাড়াও দশমিক ২০ শতাংশ কমিটমেন্ট চার্জ ও দশমিক ২০ শতাংশ ম্যানেজমেন্ট চার্জ দিতে হবে। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে পুরো ঋণ। নির্মাণ ব্যয়ের বাইরে টানেলের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বাবদ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর টানেল নির্মাণকালীন চার বছরে সুদ বাবদ ৪২৯ কোটি টাকা লাগবে। এছাড়া রয়েছে গাড়ি ক্রয়, পরামর্শকসহ অন্যান্য ব্যয় ।
উক্ত টানেল বন্দরনগরীকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে। পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। কর্ণফুলীর মোহনায় কাফকো-পতেঙ্গা পয়েন্টে টানেলটি নির্মাণ করা হবে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ৩৯ ফুট (১২ মিটার) থেকে ১১৮ ফুট (৩৬ মিটার)। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেক টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর উপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে। পাশে হবে আরো একটি টিউব। মাঝে ফাঁকা থাকবে ১১ মিটার। যে কোনো বড় যানবাহন দ্রুত ও খুব স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে এ টানেল দিয়ে। জানা যায়, টানেলের নির্মাণ কাজসহ পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পতেঙ্গা ও আনোয়ারা অংশে পিডিবির দুটি সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। হালিশহর সাবস্টেশন থেকে পতেঙ্গা টানেল পর্যন্ত নতুন ৫ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন এবং নতুন সাবস্টেশন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২০ কোটি টাকা। আগামী এপ্রিল নাগাদ নতুন সাবস্টেশনের কাজ শেষ হতে পারে। পতেঙ্গায় যেখানে টানেলের শুরু, এর কাছেই সাবস্টেশনটি ৯ম পৃষ্ঠার ১ম নির্মাণ করা হচ্ছে। এ সাবস্টেশন থেকে টানেল নির্মাণ কাজে বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি টানেলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও টানেল প্রকল্পের স্থানীয় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন আজাদীকে বলেন, ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারের ক্যাম্প, আবাসন, ব্যাচিং প্ল্যান্ট ও গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পতেঙ্গা অংশে একটি সাইট অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় জমি অধিগ্রহণ কাজও শেষ পর্যায়ে। পুরোদমে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সেখানে আনা হয়েছে। এটানেলকে ঘিরে আনোয়ারাবাসীর অনেক স্বপ্ন। আর এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন আনোয়ারা কর্ণফুলীর সাংসদ ভূমি প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।
সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, গত ডিসেম্বর থেকে টানেল প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্প কাজ পুরোপুরি শেষ হতে ৫ বছর লাগতে পারে। তবে মূল কাজ ৪ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হবে। জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য টানেল দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। এটি চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ কন্টেনারবাহী ট্রেইলর ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস আর মাইক্রোবাস। বাকি ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোটগাড়ি। টানেল নির্মাণের সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে উক্ত পূর্বাভাস জানা গেছে। -আজাদী