Home | সাহিত্য পাতা | মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৬)

মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৬)

435

শীলা ঘটক : তিতির বুঝতে পারলো আকাশের খুব খারাপ লেগেছে ইলিয়ানার কথাগুলো শুনে। আরও কিছু কথা ইনবক্সে লিখে রাখলো, যখন অন হবে তখন পড়বে এই ভেবে।
‘ আমি রকিকে জিজ্ঞেস করলাম ইলিয়ানা যা বলছে তা কি সত্যি কথা? ইলিয়ানার সাথে যখন সম্পর্ক ছিল তখন আমাকে বিয়ে করার কথা ভাবলে কেন? ও তো বেশ সুন্দরী, নাইবা হোল হিন্দু। আজকাল এসব নিয়ে কেউ ভাবে নাকি? শুনে রকি বলল, ও একজন ডিভোর্সি। মা, বাবা কোন ডিভোর্সির সাথে আমার বিয়ে দেবেনা, এইজন্য আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা সম্ভব না। আমি রকিকে বললাম, তুমি তাহলে ওর সাথে সম্পর্ক করতে গেলে কেন? রকি বলল, আমি চাইনি এই সম্পর্ক করতে, ও জোর করে আমার সাথে সম্পর্ক করেছে। খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, বাজে কথা বন্ধ করো। কেউ জোর করে কারোর সাথে সম্পর্ক করতে পারেনা। সেদিন রকির সাথে আমার খুব ঝগড়া হোল। রকি ইলিয়ানাকে যে অকারণ দোষারোপ করছে সেটা বুঝতে বাকি রইল না। এদিকে মা, বাবাকেও কিছু জানাতে ইচ্ছে করলো না। জেনেভাতে আমি তখন একা, একেবারেই একা ভীষণ একা মনে হত। ভাবলাম ইলিয়ানার সাথে আমাকে যোগাযোগ করতেই হবে। ওর ফোন নম্বরটা আমার খুব দরকার। একদিন রকি স্নানে গেছে সেইসময় ওর মোবাইল থেকে ইলিয়ানার নম্বরটা আমার ফোনে তুলে নিলাম।
চার দিন হয়ে গেছে ও এসেছিল, ফোন করাটা ঠিক হবে কি হবেনা ভাবতে ভাবতে চারদিন চলে গেছে। সেদিনের পর থেকে অবসাদে ডুবেছিলাম, কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক করলাম আজ রকি বেরিয়ে গেলেই আমি ওকে ফোন করবো। সেইদিন তোর কথা খুব মনে পড়ছিল জানিস। শুধু মনে হচ্ছিল আজ যদি শুভ থাকতো দেখাতো মজা রকিকে। তোর এই আকাশ নামটা বরং ফেসবুকের ওয়ালে ঝুলতে থাকুক। আমি আমাদের সেই চির চেনা পরিচিত নামেই আবার আজ থেকে থেকে তোকে ডাকবো।
জানিস শুভ সেদিন খুব কেঁদেছিলাম তোর জন্য। মনে হয়েছিল তুই যদি জানতে পারতিস আমি ভালো নেই যেভাবে হোক ঠিক এসে পৌঁছে যেতিস আমার কাছে। সেই রাতে তুই যেভাবে আমাকে বাঁচিয়েছিলি সেটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা রে। এই শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে তোকে ভোলা সম্ভব নয়। তাইতো এতোগুলো বছর ধরে তোকে কিভাবে খুঁজেছি তুই জানিস না।
তারপর ফোন করলাম ইলিয়ানাকে। ফোনে আমার গলা পেয়ে খুব কাঁদছিল। বলল, তোমার সাথে দেখা করেছি বলে পরেরদিন এসে আমাকে প্রচণ্ড মারধোর করেছে, যদি ছবি তুলে রাখতে পারতাম তাহলে তোমাকে দেখাতে পারতাম। আমার ড্রেস ছিঁড়ে দিয়েছে। ইলিয়ানা কাঁদতে থাকে। আমি বললাম, তুমি যে ডিভোর্সি সেটা তুমি রকিকে জানিয়েছিলে? ও বলল, হ্যাঁ ও সব জানে। আমি প্রতারণা করা পছন্দ করিনা। আমার প্রথমে ইচ্ছে ছিল না রকির সাথে সম্পর্ক করার। ওর ইচ্ছেতেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে আমাদের চ্যাটিং দেখাতে পারি, ও সব মেনে নিয়েছিল তাই ………আমি বললাম, না সেসব আমি দেখতে চাইনা। মনের মধ্যে তুফান…… কি প্রচণ্ড অন্ধকার সারা পৃথিবী ……… সমুদ্রের জল ফুলে ফুলে উত্তাল হয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, চোখ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে… আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। জেনেভা শহরটা আমার চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে। ফোন বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। রকির কথা মনে পড়লে ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠছিল আমার। আমি কিভাবে থাকবো এর সাথে! দেশ ছেড়ে বিদেশে আমার বাবা বিয়ে দিল এমন ছেলের সাথে??!!
কি করবো? কিভাবে আমি দেশে ফিরবো? ফিরতে আমাকে হবেই। এখানকার কিছুই আমি চিনিনা। কারোর সাথে তখনো আলাপ পরিচয় হয়নি।
রকি যা বলেছে সব আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে। শুধু তাই নয় ও যেমন ইলিয়ানাকে ঠকিয়েছে তেমন ঠকিয়েছে আমাকে। ফোন টা অফ করে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এই মুহূর্তে আমি একা ইন্ডিয়াতে ফিরতেও পারবো না। প্লেনের টিকিট পেতে সময় লাগবে, তাছাড়া টিকিট কাটতে গেলে রকির সাহায্য আমার লাগবে। সেই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন টাকা পয়সাও ছিলনা। জেনেভাতে আসার সময় বাবা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিল, কিন্তু সেই টাকা এখানে মার্কেটিং করে অনেকটা খরচ করে ফেলেছি, যৎসামান্য যা ছিল তাই দিয়ে টিকিট কাটা যাবেনা। এখানে আমাকে একটা কাজের জোগাড় করতে হবে, টাকা পয়সার খুব দরকার। রকিকে জানালাম, আমি সার্ভিস করতে চাই। ঘরে বসে আমার সময় কাটবেনা। তাছাড়া এখানে সবাই কাজ করে। শুনে রকি বলল, সে ঠিক আছে কিন্তু তার আগে তোমাকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে হবে, নাহলে কারোর সাথে কথা বলতে পারবেনা।
ভর্তি হয়ে গেলাম ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার স্কুলে। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস হয়। তাও একটু একা বের হবার সুযোগ হোল। মাঝে মাঝে ইলিয়ানাকে ফোন করে কথা বলতাম। এই অজানা শহরে একমাত্র ইলিয়ানা আমার খোলা আকাশ।
একদিন স্কুল থেকে ইলিয়ানা নিয়ে গেল ওর ফ্লাটে। খুব সুন্দর করে সাজানো ওর ফ্ল্যাট। দরজা দিয়ে ঢোকার পর চোখে পড়লো যীশুখৃষ্টের বিশাল একটা ফটো। মোমদানিতে তিনটে মোম জ্বলছে। অপার শান্তিতে ভ’রে গেল মন আমার। ইলিয়ানাকে বললাম, আবার আসবো তোমার কাছে। রকির এই অমানবিক ব্যবহারে আমি যেমন কষ্ট পেয়েছি তার থেকেও অনেক বেশী কষ্ট পেয়েছে ইলিয়ানা। যাকে ভালবেসে তার সন্তানের মা হতে চেয়েছিল, সেই সন্তানকেও হারালো তারই জন্য। জোর করে নষ্ট করিয়েছে রকি ওকে বিয়ে করবেনা বলে। তুই ভাবতে পারছিস শুভ? কি দিন গেছে আমার?!!’

আকাশ একমনে পড়তে থাকে ম্যাসেজটা, দীর্ঘ লেখা। একনাগাড়ে এতক্ষণ ধরে পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল সেইসময়ের কথা, তিতির, সুরমা, অণুরিমা, কাজরী, স্নিগ্ধা, রঙ্গন, কৌশিক, পল্লব শ্রেয়া, রুদ্র, সেই গ্রুপের প্রত্যেকটি ছেলে মেয়ে খুব ভালো ছিল। কতকি মনে পড়ছে, এক ঝাঁক স্মৃতি প্রবল গতিতে ধেয়ে আসছে শুভর দিকে। আজ আর কিছু মনে করতে চায়না সে, অতীত চাপা পড়ে থাকুক, আর মনে করতে চায়না সে। যা ফেলে এসেছে তা পড়ে থাকুক পিছনে। কানে ভেসে আসছে তিতির, সুরমার গান, রঙ্গনের জাজ বাজানোর সেই ঝাঁঝালো শব্দ, কৌশিকের নাল বাজানোর আওয়াজ…… পল্লবের বাঁশির সুর…… আর শুভর গীটারের সুরের ঝঙ্কার। সামনে দর্শকের আসন কানায় কানায় পূর্ণ, কি প্রচণ্ড ভিড় !! একটার পর একটা অনুষ্ঠান বিভিন্ন জায়গায়। লাল, নীল, সবুজ হলুদ আলো…… স্টেজের মাঝখানে ঘুরছে লাইটিং বল…… ঘুরছে ……ঘুরছে…… কাঁচের লাইটিং বলের আলো ঠিকরে এসে পড়ছে শুভর চোখে…… দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে শুভ।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!