Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | একরামুলের মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন

একরামুলের মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন

image-82795-1527505911

নিউজ ডেক্স : কক্সবাজারে মাদকবিরোধী চলমান অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত টেকনাফ পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হক আদৌ এই কারবারে জড়িত ছিলেন কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার বিরুদ্ধে ১০ বছর আগে মাদকের একটি মামলা হলেও সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

একরামুলের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। সংসার চালাতেই তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। বাবার বাড়িতে থাকতেন। দলীয় নেতাদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে তিনি দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাতেন।

প্রশ্ন উঠেছে, ইয়াবা কারবারের হোতা হলে কারও আর্থিক অবস্থা শোচনীয় থাকে কী করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একরামুলের সঙ্গে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরোধ তৈরি হয়। সে সময় তিনি তাকে মাদকের মামলা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের তদন্তে একরামুল নির্দোষ প্রমাণ হন।

কৈশোর থেকে রাজনীতিতে জড়িত একরামুল এলাকায় যে ভীষণ জনপ্রিয়, সেটি তার মৃত্যুর পরে বোঝা গেছে। তার জানাযায় বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত উপস্থিতি এই বন্দুকযুদ্ধকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

২৬ মে দিবাগত রাতে কক্সবাজারে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন একরামুল। গত ৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে এ রকম বন্দুকযুদ্ধ বা গোলাগুলিতে শতাধিক প্রাণ গেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে আসছে, তাদের অভিযানে নিহতরা সবাই মাদকের কুখ্যাত কারবারি। তারা নিজেরা যেমন সশস্ত্র, তেমনি তাদের সঙ্গীরাও তেমনি অস্ত্রধারী। তারা গুলি করলে পাল্টা গুলিতে নিহত হয়েছেন সন্দেহভাজনরা।

এই বর্ণনা অবশ্য এবারই প্রথম না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে র‌্যাব ব্যাপকভাবে ক্রসফায়ার শুরুর করার পর থেকেই এমন দাবি করে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে অবশ্য ক্রসফায়ারের বদলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দের ব্যবহার শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী। যদিও এই বর্ণনা কখনও গ্রহণযোগ্যতা তা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি।

মাদকবিরোধী চলমান অভিযানে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’র বর্ণনাকে বিশ্বাস করছেন না মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি এই প্রক্রিয়ার বদলে বিচার করে সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বিএনপি এবং সমমনারাও এই অভিযানের সমালোচনা করে প্রচলিত আইনে আসামিদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে।

অভিযানে এখন পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই মাদক, হত্যা, সন্ত্রাসের একাধিক মামলা রয়েছে। নিহতদের বহুজন স্থানীয়ভাবে কুখ্যাতও।

তবে একরামুলের বিষয়টি ভিন্ন। তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড থেকে তিন বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। ভোটের ফলই বলছে, স্থানীয়দের কাছে নেতা হিসেবে তিনি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

উপজেলা সামাজিক বনায়ন কমিটির সভাপতি ও টেকনাফ বাসস্টেশন বনিক সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন একরামুল।

স্থানীয় শ্রমিক নেতারা জানান, এক সপ্তাহ আগে গাড়ির চালকদের মধ্যে বিরোধ নিয়ে একটি বিচার করতে একরামুলের কাছে যান তারা। কিন্তু ইয়াবা কেন্দ্রীক ঘটনা হওয়ায় তার বিচার শুনে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বিষয়ে অস্বীকার করেন তিনি।

টেকনাফ মডেল থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘একরামুল হকের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে কোনো মামলা ছিল না। তবে বন্দুকযুদ্ধেও ঘটনায় র‌্যাব হত্যা, অস্ত্র ও ইয়াবা মামলা করেছে।’

ইয়াবা কারবারি হলে আর্থিক অনটন কেন?

‘বন্দুকযুদ্ধে’ টেকনাফের কাউন্সিলরের মৃত্যুর পর তার আর্থিক অসঙ্গতির বিষয়টি সামনে এসেছে। এই বিষয়টি তার মাদক কারবারির পরিচয়কেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
একরামের নিজের কোনো ঘর বাড়ি নেই। বাবার বাড়িতে দুটি কক্ষে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। তিনি পাঁচ বছর আগে বাবার জমিতে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করলেও টাকার অভাবে তা শেষ করতে পারেননি।

এই জনপ্রতিনিধির এক মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে এবং এক মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। টাকা পয়সার অভাবে তাদেরকে ভালো স্কুলে দিতে পারেননি একরাম।

মাসের বাজারের একটি বড় অংশই বাকিতে করে থাকে একরামের পরিবার। দোকানিদের কাছে অনেক দেনাও আছে তার।

একরামের মৃত্যুর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পর্যায় এবং সামাজিক মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে। অতীতে একরামের সঙ্গে রাজনীতি করা কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তিনি স্পষ্টতই লিখেছেন, চক্রান্ত হয়েছে একরামুলকে নিয়ে।

নিহত জনপ্রতিনিধির আর্থিক করুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে কক্সবাবারের মেয়র লেখেন, ‘যার চাল চুলো নেই, থাকার জন্য বাড়ি নেই। পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর জন্য যাকে নির্ভর করতে হয় ভাইদের উপর, বন্ধুদের উপর। আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে জনগণকে সেবা করতে গিয়ে দেনার দায়ে যার সব শেষ তাকে বানানো হচ্ছে ইয়াবা গড়ফাদার! হায় সেলুকাস।’

র‌্যাব যা বলছে
একরামুলেকে মাদককারবারি আখ্যা দিয়ে কক্সবাজারে র‌্যাব-৭ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বলেন, ‘সে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে ছিল। এই তালিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা। অপরাধ জগতে সে ইয়াবা গডফাদার হিসেবেও পরিচিত।’

‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী দুটি মামলায় একরামুল অভিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফ থানায় একটি মাদক সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলা রয়েছে।’

তবে টেকনাফ থানার ওসি রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া জানান, এই থানায় একরামুলের নামে দুটি মামলা হয়েছিল। এর একটি মারামারি নিয়ে ও অপর মামলাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।

‘২০০৮ সালে করা প্রথম মামলাটি আদালত খারিজ করে দেয়। আর মাদক সংক্রান্ত মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এতে বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

স্থানীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও একরামুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তার ইন্ধনে ‘মিথ্যা’ মামলা
একরামুলের বিরুদ্ধে ১০ বছর আগে একটি মামলা করার কারণ জানিয়েছেন কক্সবাজারের মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী। তিনি জানান, ২০০৮ সালে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে একরামের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে তখন তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও হয়েছিল। যদিও মামলাটি ‘মিথ্যা’ প্রমাণ হয় এবং একরামুল নির্দোষ প্রমাণিত হন।

২০১০ সাল পর্যন্ত ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা কক্সবাজারে ছিলেন। তখনও তিনি একরামুলকে মাদক কারবারি হিসেবে প্রমাণের নানা চেষ্টা করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার পাঠনো তালিকায় একরামুলকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে ২০১০ সালে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা কক্সবাজার থেকে বদলি হওয়ার পর ওই তালিকা থেকে একরামুলের নাম বাদ যায়।

ফাঁসানো হয়েছে: আ.লীগ নেতা

ইয়াবা কারবারির পরিচয় দিয়ে একরামুলের মৃত্যুর ঘটনাটি মানতে পারছেন না টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো গ্রুপ ষড়যন্ত্র করে তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম দিয়ে হত্যা করিয়েছে।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির সঙ্গেও এরকামের বিরোধের বিষয়টিও সামনে এসেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বদির পক্ষে নির্বাচন পরিচালনা করেন একরাম।

তবে বদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর একরামের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়। আর পৌরসভার নির্বাচনে তার বিরোধিতা করেন সংসদ সদস্য। তারপরও তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

একরামুল হক ১১ বছর ধরে উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার বাবা মৃত আবদুল সত্তর আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন।

সূত্র : ঢাকাটাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!