Home | সাহিত্য পাতা | মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৭)

মেঘের আড়াল থেকে (পর্ব- ৭)

443

শীলা ঘটক : কিছুদিন ধরে শুভকে খুব অন্যমনস্ক দেখে শুভর মা একদিন জানতে চাইল, ‘কি হয়েছে তোর বলতো? কি যেন চিন্তা করিস সবসময়, কি হয়েছে তোর? ব্যবসায় কিছু হয়েছে?
শুভ এড়িয়ে যায়, মাকে কিছু জানাতে চায়না। হাসতে হাসতে বলে, ‘কি হবে আবার? আমার কিছু হয়নি তো’। তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভাবো কেন বলতো? আমি কি বাচ্চা নাকি? তুমি যাও তো রান্না শেষ করো। আমি অফিস যাবো’।
অফিসে গিয়ে মোবাইল খুলে তিতির কে ম্যাসেজ পাঠায়, ‘ গুড মর্নিং, কি করছিস?’ তারপর কি হয়েছিল সব বল আমায়। এরপরও তুই কেন আবার জেনেভাতে থেকে গেলি?’ ম্যাসেজ দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়।
তিতির ম্যাসেজটা পেয়ে আবার লিখতে থাকে, ‘এরপর আমার সাথে রকির সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। ওর সাথে থাকা, ওর শয্যাসঙ্গিনী হওয়া কতটা কষ্টকর বুঝতেই পারছিস। ফ্রেঞ্চ ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ইলিনিয়ার সাথে আমি যোগাযোগ রেখে চলি আর সেটা রকিকে না জানিয়ে। গোপনে আমি ওর বাড়ি যেতাম, একসময় আমার খুব ভালো একজন বন্ধু হয়ে ওঠে ও। একদিন ইলিয়ানাকে বললাম, আমার একটা সার্ভিস খুব দরকার। কিছু টাকার খুব প্রয়োজন। শুনে ইলিয়ানা বলল, আমার কাছ থেকে নাও, আমি তো তোমার বন্ধু। রকি যখন প্রথম এখানে আসে, আমার সাথে আলাপ হবার পর অনেক টাকা দিয়েছি আমি ওকে। বছরে দুবার করে বাড়ি যেত, আমি ওকে প্লেনের টিকিট কেটে দিতাম। কখনো কখনো রকি সেই টাকা ফেরত দিতে আসতো আমায়, আমি কোনদিন নিইনি। শুনে আমি বললাম, না না আমার টাকা লাগবেনা, এখানে একটা চাকরি পেলে ভালো হয়। আমার সময় কাটতে চায়না।
ইলিয়ানার সাহায্য নিয়ে বেশ কতকগুলো কোম্পানিতে আপ্লিকেশন করি। কিন্তু কোন জায়গা থেকেই সাড়া পেলাম না। এইভাবে বছর ঘুরতে চলেছে। একদিন রকিকে বললাম, আমি ইন্ডিয়াতে যাবো। আর ভালো লাগছেনা এখানে, কতদিন মা, বাপিকে দেখিনি। খুব মনখারাপ করছে আমার। শুনে রকি বলল, দুমাসের মধ্যেই আমরা যাচ্ছি , টিকিট কাটতে দিয়েছি। শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণাম করে বললাম, ঠাকুর এই নরক থেকে আমাকে মুক্তি দাও। রকিকে বললাম, আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবোনা, ওখানে থাকবো কিছুদিন, পড়ে আমি একা আসবো, তোমাকে আনতে যেতে হবেনা।

এরপর আমি রকির সাথে কোলকাতা ফিরলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বাপি, মা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেল আর রকি নিজের বাড়িতে চলে গেল। যাবার সময় বাপিকে বলল, কাল বিকেলে আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো । এগিয়ে চলেছি বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করলো না আমার। বাড়িতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম, ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, মা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো যে আমি সুখী নই রকির সাথে, আমাকে জাপটে ধরে মাও কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
বাপি, মাকে সব জানালাম, কেমন ছিলাম আমি জেনেভাতে। ইলিয়ানার সমস্ত ফটো দেখালাম। ওদের আগের মেলামেশার কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি আমি ইলিয়ানার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। এমন কি ইলিয়ানার বাড়িতে আমি যখন যেতাম কল রেকর্ডার ওপেন করে রাখতাম, যাতে ও যা বলছে সব যেন রেকর্ডিং হয়ে থাকে। রকি এর বিন্দু বিসর্গ জানতে পারেনি।
আমি, মা, বাপি শ্বশুরবাড়িতে গেলাম পরদিন বিকেলে, আমার শ্বশুর শাশুড়িকে বাপি সব কথা জানালো। আমি মোবাইল খুলে সমস্ত ফটো, ভয়েস রেকর্ড ওনাদের শোনালাম। রকিও সেদিন ওর বাড়িতে ছিল। ওনারা শুনে একেবারে থ! ওনারা রকিকে বললেন, তুই এই মেয়েটার জীবন কেন নষ্ট করতে গেলি। ডিভোর্সি হোক বা খৃষ্টান, তাতে কি এসে গেল, মেয়েটা তোকে ভালবাসে তোরা ওখানে একসাথে থাকতিস যখন, তখন ইলিয়ানার কথা আমাদের বলে দেখতিস। আমরা তো এমন কোনদিন বলিনি যে, হিন্দু ছাড়া বিয়ে দেবো না।
ওনাদের কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম! তারমানে রকি, ইলিয়ানাকে মিথ্যে কথা বলেছে! আমার শ্বশুরমশাই নিতান্ত ভালোমানুষ, উনি বললেন, তিতির, তুমি কি ওর সাথে থাকতে চাও? যদি না থাকতে চাও তাহলে এখনি ওর সামনে সেকথা জানাও।
আমার মন ভাবার অবকাশ নিলনা, সাথে সাথেই বললাম, না এমন একজন ফ্রডের সাথে আমি ঘর করতে পারবো না। এই কটা মাস আমি যে কি কষ্ট করে ওখানে ছিলাম তা আমি আপনাদের বলে বোঝাতে পারবোনা। দূরে দাঁড়িয়ে আমার শাশুড়িমা কাঁদছিলেন।এই কয়মাসের মধ্যে এমনভাবে ছেলের সংসার ভেঙে যাবে সেটা উনি ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না, বুঝতে পারছিলাম ওনার অবস্থা দেখে। রকি ঘরের এককোণে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
এর কিছুদিনের মধ্যে আমার সাথে রকির মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল। রকি আবার ফিরে গেল জেনেভাতে। আমি কোলকাতায় রয়ে গেলাম। কিন্তু ভালো লাগছিল না একদম।
একদিন বাপিকে বললাম, শুভর সাথে আমার কোন প্রেম ছিল না, ছিল শুধু নিখাদ বন্ধুত্ব। তুমি সেদিন ওকে যেভাবে অপমান করলে আমি আজও মেনে নিতে পারিনি। স্ট্যাটাস কে বড় করে দেখে আমার সাথে শুভর বন্ধুত্বকে তুমি মেনে নিতে পারনি। শুভ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে সে আমার বন্ধু হবার যোগ্য নয়, সেদিন এটা মনে করে শুভকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছিলে। বাপি, আজও ভুলিনি আমি সেকথা! তোমার সব অপমান সহ্য করে, তোমাকে প্রণাম করে হাসিমুখে শুভ বেরিয়ে গিয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে। স্ট্যাটাস কি পয়সা দিয়ে মাপা যায় বাপি?! আমার মনে হয় যায়না। শুভ মতো ছেলেরা লাখে একটা জন্মায় কিনা সন্দেহ। যার বিপদের কথা শোনে, তারই পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, ঠিক সেদিন যেমন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল ও। তুমি ওকে ভুল বুঝে কি না বললে!! ভাবলে লজ্জায় আজও আমার মাথা হেঁট হয়ে আসে।
তারপর তোমার স্ট্যাটাসের রকিকে খুঁজে বের করলে আমার সাথে বিয়ে দেবার জন্য। দেখলে তো রকির স্ট্যাটাস??!! আমার দিকে বাপি অসহায় ভাবে তাকিয়ে ছিল সেদিন। খুব উত্তেজিত হয়ে বললাম, সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, শুভ আমাকে পাবার আশায় বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তা কিন্তু নয়। শুধুই বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
জানিস শুভ, তুই সেদিন বেরিয়ে যাবার পর খুব কেঁদেছিলাম। রুদ্র, স্নিগ্ধা এসেছিল পরেরদিন। ওরা সব শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিল! রুদ্র বার বার বলছিল, শুভর মতো ছেলেদের চিনতে পারাও একটু শক্ত। কারণ যা করে সবই গোপন করে যায়। নিজেকে প্রকাশ করার, নিজেকে তুলে ধরার কোন অভিপ্রায় শুভর নেই বলেই আঙ্কেলের শুভকে চিনতে ভুল হয়েছে। কি করবি বল! একটা ছেলে আর একটা মেয়ের বন্ধুত্ব মানেই সমাজ মনে করে তাদের মধ্যে প্রেম বা শারীরিক সম্পর্ক আছে। তার বাইরেও যে নিছক বন্ধুত্ব থাকতে পারে, এটা আমাদের সমাজ আজও বোঝে নারে!!
তিতিরের দীর্ঘ লেখা পড়ার পর, তিতির কেন আবার জেনেভাতে ফিরে গেল এটা জানার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল শুভর। লিখলো, ‘ তোর আর রকির যখন ডিভোর্স হয়েই গেছে তাহলে আবার তুই জেনেভাতে ফিরে গেলি কেন?’
তিতির লিখছে……
‘একদিন মেল খুলে দেখি জেনেভার এক কোম্পানি থেকে মেল এসেছে আমি যেন ইমিডিয়েট জয়েন করি। বাপিকে দেখালাম মেল। বাপি বলল, আমি প্লেনের টিকিট কেটে দিচ্ছি, তুমি ওদের জানিয়ে দাও যে তুমি জয়েন করবে’।
এরপর এখানে আবার ফিরে এলাম। জয়েন করলাম, তবে আমার অফিস অন্য জায়গায়। রকি যেখানে থাকে সেখান থেকে অনেকদূরে। এখানে এসে আমি ইলিয়ানার খোঁজ করেছিলাম। জানতে পারলাম ও গতমাসে জেনেভা ছেড়ে চলে গেছে’। শুভ মোবাইল বন্ধ করে ভাবতে থাকে……
ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!