পদ্মাসন সিংহ : একদা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, চিন্তায়-চেতনায়, অস্ত্র-শস্ত্রে এবং প্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রসরমান এক প্রচন্ড শক্তিশালী ব্যক্তি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তার কাছে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন ছোটবেলা থেকেই ধরা দিচ্ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে না পাওয়ায় সে ক্ষেপে গিয়ে আজ ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তার তিনটি মৌলিক প্রশ্ন হল-
১। এই মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হল?
২। এই পৃথিবীতে কোন ধর্মটা সত্যি- ইসলাম,সনাতন,বৌদ্ধ নাকি খ্রিস্টান?
৩। আমাদের এই পৃথিবীতে আসার মানে কী?
বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্বগুলোও উপরের প্রশ্নগুলোর পূর্ণাঙ্গ উত্তর দিতে পারে না। বিশেষ করে প্রথম প্রশ্নের উত্তর। জিরো আওয়ারের পূর্বে কি ছিল; আদিম মহাবিশ্ব কেনই বা এত উত্তপ্ত ছিল;বিগ ব্যাং কেন হয়েছিল এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর বিজ্ঞানও দিতে ব্যর্থ হয়েছে; যার সবগুলোই প্রথম প্রশ্নের সাথে জড়িত।বাকি দুটি অবশ্য দার্শনিক প্রশ্ন।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ঘেটেও এই প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রচন্ড রাগে সে তার অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিশেবে মানুষ হত্যা করতে লাগল।
তার যুক্তি হচ্ছে এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে অবশ্যই সত্যকে জানতে হবে। সত্যকে না জেনে এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো শুধু তাদের নিজের মতামতকেই সত্য বলে দাবি করে। এদের মধ্যে প্রচুর কন্ট্রাডিকশন।
তাই আজ যুদ্ধের প্রথমে শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে একদিনে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিনসহ ১৯২ টি দেশ ধ্বংস করে দিল। সব শেষ করে যখন আমাজন জংগলের আদিবাসীদের হত্যা করতে যখন উদ্যত হল তখন ঈশ্বর নেমে আসলেন। প্রচন্ড রাগে সবকিছু মূহুর্তের মধ্যেই লন্ডভন্ড করে দিতে গিয়েও করলেন না ঈশ্বর।
আপনারা ভাবছেন- সারা পৃথিবীর সব মানুষকে যখন লোকটা শেষ করে দিচ্ছে তখন ঈশ্বর কিছু বলেননি কেন? বিষয়টা হচ্ছে সারা পৃথিবীর এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোককে ঘৃণা করছে কেউ কাউকে ভালবাসতে পারছে না। তাই ঈশ্বরও একদিন পরিকল্পনা করছিলেন এইসব পাপীদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু ঈশ্বরের হয়ে একজন বিদ্রোহী লোক কাজটি করে ফেলেছে। ঈশ্বর রাগান্বিত হওয়ার কারণ কিন্তু অন্য। প্রচন্ড শক্তিশালী লোকটা যখন আমাজনে তার স্পেসশিপটা ল্যান্ডিং করে তখন তার আসার শব্দে আমাজনবাসী আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মনে অহেতুক আতংক সৃষ্টি করা এবং তাদের মারার পরিকল্পনাটা সর্বজ্ঞ অন্তর্যামী ঈশ্বর জানতে পেরে ঈশ্বর রাগ করেছিলেন।
মহাবিশ্বের ১১ মাত্রায় অবস্থানকারী ঈশ্বর চতুর্পাশ তীব্র আলোয় আলোকিত করে মাল্টিভার্সের সর্বাপেক্ষা সুন্দর এবং চোখ ধাধানো রুপ নিয়ে যখন বিদ্রোহী লোকটার সামনে দাঁড়ালেন তখন বিদ্রোহী লোকটা নত মস্তকে ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাল। বিদ্রোহী লোকটা তার দাবিগুলো তুলে ধরতেই তাকে থামিয়ে ঈশ্বর বলল- তুমি যে প্রশ্নগুলো জানতে চেষ্টা করছ সেগুলো মানবজাতি কখনই জানতে পারবে না, আমি তোমাদের মধ্যে একটি জ্ঞানের সীমারেখা অঙ্কন করে দিয়েছি এবং এই সীমারেখার বাইরে যাওয়া আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধ। তবে এটুকু জেনে রেখ তোমার প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর যদি পেয়ে যাও তাহলে তৃতীয় প্রশ্নটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই আমি চাই না মানজাতি চরম নিরর্থকতার মধ্যে দিয়ে জীবন পার করুক এবং এটা আমারই খেলার একটি অংশ।
বিদ্রোহী লোকটা এবার ঈশ্বরকে প্রশ্ন করল- হে ঈশ্বর, আমি যখন পৃথিবীর সমগ্র সভ্য মানবজাতিকে ধ্বংস করছিলাম তখনও তো আমাকে থামাতে পারতেন, কিন্তু কেন বাঁধা দেননি? আর আমাজন জংগলের অসভ্য/তুচ্ছ একটি মানবগোষ্ঠীকে বাঁচানোর জন্য কেন আপনি আমাকে থামালেন?
উত্তরে ঈশ্বর বললেন- এরা তোমার মত সভ্যদের কাছে তুচ্ছ হলেও আমার কাছে এরাই আসল মানুষ।
ঈশ্বর কিন্তু প্রচন্ড যুক্তিবাদী। যুক্তির বাইরে গিয়ে কোন কিছু করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
তাই তিনি ঐ বিদ্রোহী লোকটাকে বললেন-
“ঐ আমাজনের জঙ্গলের তথাকথিত অসভ্য জনগোষ্ঠী আমি কি বা কে; সেটা তারা জানে না। তারা কোন দিনও আমার শরণাপন্ন হননি। তাদের মধ্যে কোন ধরণের হিংসা-বিদ্বেষ নেই। তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে জংগল থেকে পশু শিকার করে খায়। তাদের মধ্যে তোমাদের মত হানাহানি, ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং অহেতুক লোভ নেই। তোমরা যতই সভ্য হয়েছ ততই কৃত্রিম হয়েছ; ততই আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছ। লোভে পড়ে তোমরা আমার এই অপূর্ব সৃষ্টির ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলেছ। হাজার হাজার ধর্ম সৃষ্টি করে মানুষে-মানুষে বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছ। বাইরে কেউ প্রকাশ না করলেও এক ধর্মের লোক হয়ে অন্য ধর্মের লোকের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা পোষে রেখেছ।এর কারণেই তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। তুমি না করলে কিছুদিন পরে আমিই এই ধ্বংসলীলা শুরু করতাম।”
তারপর ঈশ্বর ঐ সাহসী বিদ্রোহী লোককে আদেশ করলেন- আমাজনের জঙ্গলের প্রাণিদের নিয়ে সবকিছু আবার নতুনকরে শুরু করতে।
বিদ্রোহী লোকটা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলের আদিম মানুষদের সাথে মিশে গেল। বিদ্রোহী লোকটা লক্ষ করল এই জঙ্গলের মধ্যে দিব্যি মানিয়ে নিতে পারছে এতে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। বিদ্রোহী লোকটা যেহেতু অসম্ভব জ্ঞানী তাই তার জানা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বসমূহ যেমন- নিউটনের পদার্থবিদ্যা, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্রিং থিওরি এবং রসায়নের যত জ্ঞান, বিবর্তনবাদ ও জীববিজ্ঞানের যত জ্ঞান আর সাহিত্য-শিল্পকলা, পলিটিক্স, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস ইত্যাদি আমাজন জঙ্গলের লোকদেরকে শিখিয়ে নতুন এক চমৎকার সভ্যতা গড়ে তুলল। যেটাকে আমরা এককথায় বলতে পারি হ্যাভেন বা স্বর্গ। লেখক : সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সুনামগঞ্জ ও সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।