
নিউজ ডেক্স : জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ। যে সময়ে তাদের থাকার কথা ছিল নির্বরতার স্থান মাতৃক্রোড়ে, সেই বয়সে তাদের ঠাঁই হচ্ছে আস্তাকুঁড়ে, কখনো পথের ধারে কিংবা রেললাইনে। কখনো তাদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, কখনো ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে চলন্ত সিএনজি টেক্সি থেকে। কেন এই নির্মমতা? নগরীর যত্রতত্র নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়ার হার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এমন অবস্থা আগে তেমনটা ছিল না। গত এক দশক ধরে নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। এদের কেউ মরে বেঁচে যায়, কেউ বেঁচে মরে থাকে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন মনে করছেন, মূলত সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাবের কারণেই ডাস্টবিনে নবজাতক শিশুদের ফেলে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে কদাচিৎ কাউকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ নবজাতকই মৃত্যুবরণ করে। একইসঙ্গে সামাজিক সমাধান না পেয়ে ডাস্টবিনে, রাস্তার ধারে নবজাতককে ফেলে গিয়ে অনেকে দায় থেকে মুক্তির পথ খোঁজে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশেও শিশু যত্নকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গাগুলোতে মানসম্মত সেবার অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব শিশুর পরিচর্যার দায়িত্ব নেওয়া। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে এই বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার। এ ধরনের অবস্থাকে কীভাবে মোকাবেলা করবে, সেগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে এ নিয়ে গণসচেতনতাও তৈরি করতে হবে। নগরীর খুলশী থানাধীন পলিটেকনিক্যাল এলাকায় চলন্ত সিএনজি টেক্সি থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া এক শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ।

চিকিৎসকদের বরাতে পুলিশ জানায়, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারণে বেশি আঘাত পেয়েছে শিশুটি। তার অবস্থা আশংকাজনক। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আনুমানিক ৭ মাস বয়সী ওই মেয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। – আজাদী
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বলেন, দুপুরে চট্টগ্রাম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন থানার এএসআই হিরণ মিয়া। হঠাৎ তিনি দেখতে পান দ্রুতগামী একটি সিএনজি টেক্সি থেকে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি দ্রুত গিয়ে দেখেন কন্যা শিশুটিকে। পরে শিশুটিকে উদ্ধার করে চমেকে নিয়ে আসা হয়।
নগরীর চান্দগাঁও থানার বরিশাল বাজার এলাকা থেকে চার মাস বয়সী এক নবজাতক শিশু চুরি হওয়ার পর অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে দেখা যায়, সন্তান বিক্রিতে জড়িত অপরাধে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে নবজাতকটির বাবাও আছেন।
চান্দগাঁও থানা পুলিশ জানায়, নবজাতকটিকে বিক্রি করে দিয়েছিল তারই বাবা মো: ইসহাক। কিন্তু তিনি প্রথমে পুলিশকে ভুল তথ্য দেন। পরবর্তীতে পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখতে পায় বাচ্চাটি ইসহাক স্বেচ্ছায় বিক্রি করেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি বিষয়টি স্বীকারও করেন। আর্থিক অভাবের কারণে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি বাচ্চাটিকে বিক্রি করেন রোজি নামের এক মহিলার কাছে। সেই রোজির কাছ থেকে শিশুটি হাতবদল হয় আরো কয়েক দফা।
গত ৩১ জানুয়ারি সকালে একজন লোক এসে ডবলমুরিং থানার এসআই আলাউদ্দিনকে জানান যে রেললাইনের পাশে এক নবজাতক কান্না করছে। একটু এগোনোর পর দেখা যায়, রক্তমাখা শিশুটি রেললাইনের পাশে পড়ে আছে। দূরে পড়ে আছে রক্তস্নাত এক নারী। কথা বলে দেখা যায় মানসিক ভারসাম্যহীন ওই নারী। পরে স্থানীয় এক নারীর সহযোগিতায় শিশুটি ও তার মাকে নিয়ে যাওয়া হয় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে। জন্ম হওয়ার পরবর্তী চার ঘণ্টা খালি গায়ে পড়ে থাকার কারণে শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। শিশুটিকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) এবং তার মাকে গাইনি ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের চিকিৎসায় সহায়তা দেয়া হয়।
এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার মোস্তফা কলোনির পশ্চিম শহীদনগর ওয়েল মিলস জি.সি ফ্যাক্টরির পাশে ময়লার স্তুপ থেকে এক নবজাতক শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। চিকিৎসার পর সুস্থ থাকায় অভিভাবকহীন নবজাতকটিকে চমেক হাসপাতাল থেকে লালন-পালনের জন্য রৌফাবাদ সরকারি ছোট মণি শিশুনিবাসে পাঠানো হয়।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রিটন সরকার জানান, রাকিব (১৩) নামে এক পথশিশু সকালে ময়লার স্তুপের মধ্যে কাগজ কুড়াতে গিয়েছিল। সেখানে নবজাতক শিশুর কান্না শুনতে পেয়ে সে পুলিশের কাছে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে শিশুকন্যাটিকে উদ্ধার করে।
৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগ্রাবাদের গ্রামীণ ফোন সেন্টারের সামনে রাস্তার উপর সন্তান প্রসব করে রোজিনা নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী। খবর পেয়ে রোজিনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মানবিক পুলিশ সদস্য এসআই মাসুদুর রহমান। এসআই মাসুদুর রহমান বলেন, রোজিনা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তার ছেলের নাম রাখা হয়েছে আয়াত। সে এখন এক ধর্নাঢ্য পরিবারে বেড়ে উঠছে।
গত বছর ৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিমচাল কবিরার এলাকায় রাস্তার ধারে এক দোকানের সামনে এক পাগলীর গর্ভে জন্ম হয় এক নবজাতক। রাতের আঁধারে প্রসব বেদনায় চিৎকার শুনে গন্তব্যে ছুটে যান পশ্চিমচাল কবিরা গ্রামের স্থানীয় কিছু যুবক ও নারী। সেখানে জন্ম হয় ছেলে শিশুটির। এ সময় তাদের উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন এক নারী। বর্তমানে মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছেন।
গত বছর ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পূর্ব গেটের কাছে একটি ডাস্টবিনে দুই নবজাতককে নিয়ে কুকুর টানাটানি করছিল। খবর পেয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক ইমাম হোসেন কুকুরের মুখ থেকে বাচ্চা দুটি উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠান।
ইমাম হোসেন বলেন, বাচ্চাগুলো অপরিণত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো ক্লিনিকে অবৈধ গর্ভপাতের পর কাপড় মুড়িয়ে তাদের ডাস্টবিনে ফেলে গেছে। লাশ দুটির ময়নাতদন্ত শেষে দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছ হস্তান্তর করা হয়।
১৮ অক্টোবর পতেঙ্গার নাজিরপাড়া এলাকার সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের (এসএপিএল) পাশে রাস্তার পাশ থেকে এক নবজাতককে খুঁজে পান সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর শাহানূর বেগম। তখন নবজাতকটির মানসিক ভারসাম্যহীন মা পাশে ছিল। উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। কাউন্সিলর নিজেই এই শিশুটির পরিচর্যা করছেন এখন।