নিউজ ডেক্স : দেশের বরেণ্য সাহিত্যিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী, শহীদ জায়া ও জননী বেগম মুশতারী শফী আর নেই। তিনি গতকাল সোমবার বিকেল ৫টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র, চার মেয়ে, তিন পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মুশতারী শফীর মরদেহ আজ সকাল ৯টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। এরপর মরহুমার প্রথম নামাজে জানাজা বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে মরদেহ চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে। রাতে এনায়েত বাজারস্থ ঐতিহাসিক মুশতারী ল’জে তাঁর মরদেহ রাখা হবে। আগামীকাল বুধবার সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ আনা হবে। এরপর বাদে জোহর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
মুশতারী শফীর ইন্তেকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। তারা মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। উল্লেখ্য, মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফীকে একাত্তরে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মুশতারী শফীর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিশ্লেষক শৈবাল চৌধূরী নির্মাণ করেন ‘বিস্মৃত অধ্যায়।’ বেগম মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রণ করেন। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি অসাধারণ গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি, জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’, ‘একুশের গল্প’, ‘দুটি নারী ও একটি যুদ্ধ’, একদিন এবং অনেকগুলো দিন’, ‘আমি সুদূরের পিয়াসি’সহ বেশ কিছু কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এছাড়াও তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ প্রভৃতি শাখায়ও অবদান রেখেছেন।
১৯৬০-এর দশকে তিনি চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠন থেকে তিনি ‘বান্ধবী’ নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখায় বাংলা একাডেমি ২০১৬ সালে তাঁকে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করে। তিনি ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম মহানগরীর এনায়েত বাজারে মুশতারী শফীর বাড়িতেই কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডা. মোহাম্মদ শফী ও তার স্ত্রী মুশতারী। একাত্তরের শুরুর সময় থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, সেবা ও অর্থায়নসহ নানা কাজে যুক্ত ছিলেন তারা।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বাসায় রাখায় ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ডা. মোহাম্মদ শফী এবং মুশতারীর ভাই এহসানুল হক আনসারীকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরপর ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেন মুশতারী শফী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গত শতকের ৯০ এর দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করলে তাতে সক্রিয় হন মুশতারী শফী। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পরও আন্দোলন এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় এক দশক আগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও অনুপ্রেরণাদানকারী হিসেবে ছিলেন মুশতারী শফী। মহিলা পরিষদ, উদীচীর সাথেও যুক্ত ছিলেন।
মুশতারী শফীর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন-চট্টগ্রাম একাডেমির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. অনুপম সেন, মহাপরিচালক প্রাবন্ধিক আমিনুর রশীদ কাদেরী, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর হান্নানা বেগম, নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের সভানেত্রী ড. আনোয়ারা আলম ও সম্পাদক জিনাত আজম, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের সভানেত্রী খালেদা আউয়াল, সাবেক এমপি মজহারুল হক শাহ চৌধুরী, চবি সিনেট সদস্য ও ঘাসফুল চেয়ারম্যান ড. মনজুর উল আমিন চৌধুরী, থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্রের সভাপতি হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও সেক্রেটারী আশীষ ধর, উদীচীর ডা. চন্দন দাশ ও অধ্যাপিকা শীলা দাশগুপ্তা। শোকবার্তায় তারা বলেন, মুশতারী শফীর ইন্তেকালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল সংস্কৃতি অঙ্গণে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেটা কখনোই পূরণ হবার নয়। -আজাদী