ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | হাতির জন্য আন্তঃদেশীয় করিডোর, সম্ভাব্য তিনটি পথ যুক্ত হবে ভারত-মিয়ানমারের সাথে

হাতির জন্য আন্তঃদেশীয় করিডোর, সম্ভাব্য তিনটি পথ যুক্ত হবে ভারত-মিয়ানমারের সাথে

নিউজ ডেক্স : হাতিসহ বন্যপ্রাণীর অবাধ চলাচল নিশ্চিতে সম্ভাব্য নতুন তিনটি পথ চিহ্নিত হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-বান্দরবান-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি হয়ে পথগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারকে সংযুক্ত করবে। অর্থাৎ এটি হবে আন্তঃদেশীয় করিডোর। সম্ভাব্য এ করিডোরের নাম ‘বঙ্গবন্ধু কনজারভেশন করিডোর’। প্রস্তাবিত করিডোরটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অব ট্রান্স বাউন্ডারি ওয়াইল্ডলাইফ করিডোর ইন চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট অ্যান্ড কক্সবাজার উইথ মিয়ানমার অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া বন অধিদপ্তরের প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে। তবে ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ করে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রস্তুত হয়েছে। সেখানে নতুন তিনটি পথ চিহ্নিত করা হয়।

হাতি চলাচলের সম্ভাব্য পথ : ফিজিবিলিটি স্টাডিতে চিহ্নিত সম্ভাব্য পথগুলোর প্রথমটি হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা কাসলং রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে সিজকছড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট। এখানে সিজকছড়ি হতে পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য পর্যন্ত আন্তঃসংযোগ পথও রয়েছে। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে- কাপ্তাই থেকে দুধ পুকুরিয়া ধোপাছড়ি পর্যন্ত। এখানে কাপ্তাই থেকে রইখং রিজার্ভ ফরেস্ট অথবা ধোপাছড়ি থেকে রইখং রিজার্ভ ফরেস্ট’র আন্তঃসংযোগ পথও রয়েছে। তৃতীয় পথটি হচ্ছে- চুনতি থেকে লামা, গজানিয়া হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সাঙ্গু দোছড়ি পর্যন্ত। এই অংশে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য পর্যন্ত অথবা নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে হিমছড়ি এবং হিমছড়ির সাথে টেকনাফ-ইনানি পর্যন্ত পথেরও প্রস্তাব রয়েছে।

বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে এশীয় হাতি চলাচলের জন্য দেশের তিনটি সীমানায় সংযোগ পথ তৈরির পরিকল্পনা করে পরিবেশ, বন ও জলবাযু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ লক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু কনজারভেশন করিডোর’ নামে অভয়ারণ্য তৈরিরও প্রস্তাব করা হয়। এরপর গত বছর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুই কোটি ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার ৭০৬ টাকায় নিয়োগ দেয়া হয় প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনকে (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) নিয়োগ দেয়া হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েল বেঙ্গল টাইগার : সমীক্ষা চালানোর সময় আইইউসিএন টিম কাসালং ও পাবলাখালী অভয়ারণ্যে হরিণ, শুয়োর, ভাল্লুক, বানর ও হনুমানের উপস্থিতি পেয়েছে। তাছাড়া বাঘ থাকার মত যে খাদ্য শৃক্সখল প্রয়োজন তার উপস্থিতি ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে ধরা পড়েছে। এক্ষেত্রে বাঘ বলতে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা বলা হয়।

প্রস্তাবিত করিডোর বাস্তবায়ন করার জন্য এখনো যে সবুজ রয়েছে তা সংরক্ষণ করার পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে হাতিসহ বন্যপ্রাণীদের চলাচলের পথ সুরক্ষিত করার পরামর্শ দিয়েছে আইইউসিএন। এক্ষত্রে ‘বঙ্গবন্ধু কনজারভেশন করিডোর’ বাস্তবায়ন হলে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র সুরক্ষিত রাখা যাবে।

মিয়ানমার নিয়ে শঙ্কা : হাতি রক্ষায় মিয়ানমার বাধা উল্লেখ করে আইইউসিএন’র বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রাকিবুল আমিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেশটিতে সামরিক শাসন চলছে, তাই তথ্য পাওয়া সহজ হচ্ছে না। কোন পথ দিয়ে হাতি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে প্রবেশ করে সে তথ্য আমাদের কাছে আছে। কিন্তু মিয়ানমারে চামড়ার জন্য প্রতিনিয়ত হাতি শিকার হচ্ছে। তাই দেশটিতে হাতি প্রবেশ করলে ফিরবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।

প্রকল্প এলাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের স্টাডি এরিয়া হচ্ছে পুরো পার্বত্য অঞ্চল এবং টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম-সাঙ্গু এবং উপরে কাচালং। এই পুরো অংশটাকে কানেক্ট করা। আরেকটা বিষয় আছে ট্রান্স বাউন্ডারি। এটা ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে কানেক্ট করা যাবে।

আইইউসিএন এর হয়ে প্রকল্পটিতে কাজ করছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এম মনিরুল এইচ খান। তিনি বলেন, কোন দিক দিয়ে করিডোর করা যায় সেটা আমরা সাজেস্ট করছি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অথবা মানুষের বসতি গড়ে উঠার কারণে হাতি চলাচলের অনেকগুলো পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে জায়গাগুলোতে এ ধরনের সমস্যা কম আমাদের মডেলে ওই জায়গাগুলোকে নির্দেশ করেছে।

‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অব ট্রান্স বাউন্ডারি ওয়াইল্ডলাইফ করিডোর ইন চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট অ্যান্ড কক্সবাজার উইথ মিয়ানমার অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ প্রকল্প পরিচালক এবং বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, হাতির কোনো সীমানা নাই। মিয়ানমার বা ভারতে যেসব হাতি বসবাস করে সেগুলোও আমাদের দেশে আসে। আমরা চাই আসা-যাওয়ার পথে যেন কোনো হাতি প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়ে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচল, আবাসস্থল, খাদ্য ও প্রজনন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ চারটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বন্যপ্রাণীর টিকে থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা যাবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সেটা আমরা করতে চাই।

হাতির বিদ্যমান করিডোর : বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনাঞ্চল (কাসালং) ও বান্দরবান (সাঙ্গু) বনাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে অন্য দেশ থেকে হাতি আসা যাওয়া করে। এর মধ্যে ভারতের মেঘালয় থেকে ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম থেকে কাসালং ও মৌলভীবাজার এবং মিয়ানমার থেকে আসা হাতি সাঙ্গু বনাঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করে। এসব হাতি চলাচল করে ১২টি করিডোর দিয়ে, যার ১১টি রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীনে আছে চুনতি-সাতঘর, লালটিয়া-বড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা ও নাড়িচ্ছা-কোদালা করিডোর রয়েছে। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতায় রয়েছে উখিয়া-ঘুমধুম, তুলাবাগান-পানেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারপুল। এছাড়া কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের অধীনে আছে ভোমরিয়া ঘোনা-রাজঘাট, তুলাতলি-ঈদগড়, পুচাখালি-মেধাকচ্ছপিয়া করিডোর।

বিদ্যমান করিডোরগুলোতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং হাতি হত্যা প্রসঙ্গে গত ২২ নভেম্বর একটি রিট আবেদন শুনানিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে। এতে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুসারে ১২টি ‘এলিফ্যান্ট করিডোর’ সহ অন্যান্য করিডোরগুলোকে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং হাতি হত্যা বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ সচিব, আইন সচিব, তথ্য সচিব, প্রধান বন সংরক্ষক ও বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক, জামালপুর, শেরপুর, রাঙামাটি, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবানের জেলা প্রশাসকসহ ২০ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে হবে।

কমবে হাতি হত্যা : বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ থেকে এ পর্যন্ত ১৪২টি মারা গেছে। এর মধ্যে গত দুই বছর ১১ মাসে মারা গেছে ৪৪টি। হাতিগুলোর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৩৭টি। চলতি বছরের গত ১১ মাসে তথা নভেম্বর মাস পর্যন্ত মারা গেছে ১১টি। এর মধ্যে শুধু নভেম্বর মাসেই মারা গেছে সাতটি। চলতি বছর মারা যাওয়া হাতিগুলোর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইটি এবং বিদ্যুতায়িত হয়ে পাঁচটি এবং চারটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালে ২২টি এবং ২০১৯ সালে ১১টি হাতি মারা গেছে। ২০২০ সালে তিনটিকে গুলি করে এবং পাঁচটি হাতি বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে বিদ্যুতায়িত হয়ে দুইটি, পাহাড় থেকে পড়ে একটি এবং দুটি পানিতে ডুবে মারা গেছে।

চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা এবং খাদ্য সংকটের কারণে লোকালয়ে চলে আসে হাতি। তখন লোকজন হাতি হত্যা করে। ‘বঙ্গবন্ধু কনজারভেশন করিডোর’ এর মাধ্যমে হাতির নিরাপদ পথ তৈরি হবে। তখন হাতি হত্যা বন্ধ হবে বলেও আশা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আজাদী প্রতিবেদন 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!