Home | উন্মুক্ত পাতা | রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায়

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায়

ডা. সোহরাব হোসেন : করোনা এক ধরনের ভাইরাস। এটি একটি মাত্র ভাইরাসের নাম নয়; অনেকগুলো ভাইরাসের একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ। করোনা শব্দটি ল্যাটিন থেকে এসেছে; যার অর্থ ক্রাউন বা মুকুট। ইলেকট্রন আনুবীক্ষণিক যন্ত্রের মাধ্যমে এ ভাইরাস দেখলে এর গায়ে ক্রাউন বা মুকুট সদৃশ এক ধরনের শুঙ্গ পাওয়া যায়, বিধায় ল্যাটিন ভাষায় এদের করোনা ভাইরাস বলা হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনা ভাইরাস আমাদের কাছে খুবই পরিচিত শব্দ। এখানে একটু পরিষ্কার করা দরকার যে করোনা ভাইরাস ও COVID-19 শব্দ দুটি খুব কাছাকাছি হলেও আলাদা অর্থ বহন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে যে রোগ হয় তাই COVID-19. পুরো নাম সার্স করোনা ভাইরাস-২ (SARS-Cov-2)। প্রচলিত ভাষায় এটি করোনা ভাইরাস নামে আমাদের কাছে পরিচিত।

সার্স করোনা ভাইরাস-২ এক ধরনের RNA single stranded positive-sense ভাইরাস যা দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন। ইতোমধ্যে বিশ্ব এর তাণ্ডব দেখেছে। এটি আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে মহামারি আকারে সারা বিশ্বকে সংক্রমিত করেছে। 

এ ভাইরাসের বিস্তার, লক্ষণ, প্রতিরোধ বা চিকিৎসা আজকের আলোচনার বিষয় নয়; আয়ুর্বেদ মতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার কৌশল নিয়ে আজ আলোচনা করব। কারণ এখনও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। যদিও রেমডেসিভির নামে একটি এন্টি-ভাইরাল ড্রাগের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই ড্রাগটি ভাইরাসটিকে মারতে সক্ষম কি না পরিষ্কার নয়; তবে এটি রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সহায়তা করতে পারে। 

অপরদিকে করোনার মোট ১০২টি টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। তার মধ্যে ৮টি টিকা মানব শরীরে প্রয়োগ করে এর কার্যকরিতা দেখার কাজ চলমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড -১৯ গবেষণার বিশেষ দূত ডেভিড নাবারো বলেছেন, “এমন কিছু ভাইরাস আছে, যাদের বিরুদ্বে লড়াই চালানোর টিকা এখনও আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। কোভিড -১৯ এর টিকা আদৌ বের হবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা মোটেই নিশ্চিত নই। নাও বেরুতে পারে। যদি কোন টিকা বেরও হয়, তা হলে সেটা বাজারে আসার আগে সব পরীক্ষা পাস করবে কি না, তারও গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়।” 

শেষ পর্যন্ত যদি করোনার টিকা না বের হয়, তা হলে সেটা আশ্চর্যের বিষয় হবে না, এমন মত বিশেষজ্ঞদেরও। কারণ অতীতেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে। যেমন- এইচআইভি ভাইরাসের এখনও কোন উল্লেখযোগ্য টিকা বের হয়নি, অথচ এ রোগে গত ৪০ বছরে প্রায় তিন কোটির বেশি লোক মারা গেছে।

সার্স করোনা ভাইরাস-২ এর বৈশিষ্টের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এটি দ্রুতই পরিবর্তশীল। তাছাড়া ইতোমধ্যে অঞ্চলভিত্তিক এর বৈশিষ্টের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই এর টিকা বাজারে এলেও একটি টিকা দিয়ে একে দীর্ঘ সময় দমিয়ে রাখা যাবে কি না সে চিন্তাও রয়েছে। ভাইরাসের বৈশিষ্টের পর ভিত্তি করে ধারনা করা হয়, টিকা বের হলেও প্রতিবছর টিকা দেওয়া লাগতে পারে। যেমনটা আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জা ও হেপাটাইটিস-সি এর টিকার ক্ষেত্রে দেখি। সুতরাং বছর বছর সবাই টিকা দিতে পারবে কি না সেটাও দেখার বিষয়।

অন্যদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে কাজ করছে। এই হার্ড ইমিউনিটির কিছুটা সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই রয়েছে। সে যাই হোক অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে মানবজাতির জন্য একটি টিকা খুবই প্রয়োজন। এ পর্যন্ত সবচেয়ে অল্প সময়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় টিকা তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু আরও আনেক পরীক্ষা নীরিক্ষার পর তা বাজারে আসতে পারবে। আনুমানিক হিসেবে আগামী বছরের শুরু বা মাঝামাঝি সময়ে তা বাজারে আসতে পারে। মানে এখনও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। রোগটি যে হারে ছড়াচ্ছে সে হিসাব করলে অনুমান করা যায় কত লোক আক্রান্ত হবে? তাই এ রোগ থেকে বাচাঁর বিকল্প পথ হলো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জন্মগত টিকা অর্থ্যাৎ ইন্যাট বা জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতি যত্নশীল হওয়া। এখন অবধি যাদের এই শক্তি স্বাভাবিক রয়েছে তারাই করোনাকে ভালোভাবে প্রতিরোধ বা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। 

ইন্যাট বা জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হলো এক বিশেষ শক্তি বা ক্ষমতা যা আমরা জন্ম থেকেই পেয়ে থাকি। যেমন- রক্ত। রক্তে থাকে শ্বেতকনিকা, যা জন্ম থেকে মানুষের শরীরে বিদ্যমান এবং ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্যাট ইমিউনিটি ফিজিক্যাল বেরিয়ারের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যামিকেল ফ্যাক্টর বিশেষ করে সাইটোকাইন নিঃসরণ করে ইনফেকশন প্রতিরোধ করে থাকে। কিন্তু আমাদের অবহেলা, অসচেতনতা বা অসামঞ্জস্য পূর্ণ জীবন যাপনের কারণেই ইন্যাট বা জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা আয়ুর্বেদ বা প্রাকৃতিক উপায়ে ঘরে বসেই এই ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে পারি।

আয়ুর্বেদ হলো পাঁচ হাজার বছরের পুরনো বিজ্ঞান, যাকে আমরা এই আধুনিক সময়ে প্রিভেনটিভ সায়েন্স (প্রতিরোধক বিজ্ঞান) বা ন্যাচারাল সিস্টেম অব মেডিসিন (প্রকৃতিক ওষুধ) বলে থাকি। এ বিজ্ঞানের মতে রোগের মূল কারণ হলো দেহের জীবনি শক্তি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার অসমতা। আর সংক্রামক রোগকে বলে জনপদ ধ্বংসী রোগ। অর্থাৎ যে রোগ কোন এলাকায় বা স্থানে বসবাসকারী জনগণকে আক্রান্ত করে এবং ছড়িয়ে পড়ে, যা আধুনিক মহামারি সদৃশ। 

আয়ুর্বেদ মতে এ রোগের কারণ হলো- বায়ু, জল, দেশ ও কাল দূষিত হওয়া। এ ধরনের রোগ থেকে মুক্তির উপায় হলো হেতু বিপরীত অর্থাৎ কারণ বিপরীত চিকিৎসা। যেমন- আলাদা থাকা, অন্যজন থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, স্বস্থ্যবৃত্ত অর্থ্যাৎ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, জীবন যাপনে পরিবর্তন আনা, রসায়ন চিকিৎসা অর্থ্যাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্বিকরণ এবং উপসর্গ প্রশমন।

আয়ুর্বেদ মতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ঠাণ্ডাা-কাশিসহ কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:

যারা আক্রান্ত হননি তাদের জন্য:  
১. সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
২. সূর্য ওঠার পূর্বেই ঘুম থেকে ওঠা
৩. ঘুম থেকে ওঠার পর পরই মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস করা
৪. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে প্রার্থনা করা
৫. খালি পেটে ১ গ্লাস পানি পান করতে পারেন
৬. সকাল বেলা মধু লেবুর শরবত/চিনি মুক্ত গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন
৭. সূর্য স্নান অর্থাৎ খালি গায়ে কিছুটা সময় সকাল বেলা সূর্যালোকে দাঁড়ানো। এতে ভিটামিন ডি শরীরে বৃদ্ধি পাবে। রোগ-প্রতিরোধে ভিটামিন ডি খুবই প্রয়োজন।
৮. ৩০ মিনিট যোগাসন, প্রাণায়ম বা মেডিটেশন করতে পারেন অথবা হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। এক্ষেত্রে লকডাউনের মধ্যে বাসার কাজে সহায়তা করতে পারেন।
৯. ধুমপান, মদ্যপান না করা
১০. পর্যাপ্ত ঘুম (৬ -৮ ঘণ্টা) প্রয়োজন
১১. অতিরিক্ত রাত না জাগা
১২. দুশ্চিন্তা পরিহার করা 
১৩. সময়ের প্রতি যত্নশীল ও মনে প্রাণে আদর্শবান হওয়া

ঋতুভিত্তিক কিছু বিধি-নিষেধ: এখন যেহেতু গ্রীষ্মকাল (মে-মধ্য জুলাই), তাই এ সময়ের জন্য কিছু পরামর্শ:
১. মিষ্টি ও রসালো ঠাণ্ডা জাতীয় ফল বেশি বেশি খাওয়া
২. খুব অল্প পরিমান ঘি ও দুধ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা 
৩. অপেক্ষাকৃত শীতল জায়গায় থাকা এবং হালকা, ঢিলেঢালা জামা পরিধান করা
৪. সন্ধ্যায় হালকা ঠাণ্ডা পানি পান করা। এখানে একটি ভ্রান্তি আছে যে সবাই গরম পানি পান করছেন। সেটা সঠিক নয়। গরম পানি পান করবেন শুধুমাত্র অসুস্থ রোগী। বেশি বেশি গরম পানি খেলে আমাদের খাদ্যনালীতে বিদ্যমান নরমাল ফ্লোরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 
৫. এই ঋতুতে ঝাল ও অতিরিক্ত গরম খাবার পরিহার করা  

রোগ প্রতিরোধে খাদ্য উপাদান ও বিধি-নিষেধ:
১. পচা-বাসি খাবার পরিহার করা, গরম গরম খাবার খাওয়া
২. প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমান মতো আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাদ্য অন্তর্ভূক্ত রাখা। 
৩. পূর্বের খাদ্য হজম হলে পরবর্তী খাদ্য গ্রহণ করা, একবারে অতিরিক্ত পেট পুরে খাবার না খাওয়া
৪. অতিদ্রুত বা অতি ধীরে খাদ্য গ্রহণ না করা
৫. খাবার খাওয়ার সময় মনোযোগ সহকারে খাওয়া, হাশি-তামাশা না করা
৬. খাবারে হলুদ, জিরা, ধনিয়া ও রসুনের আধিক্য রাখা
৭. সকল ধরনের ফল গ্রহণ করা যায়। তবে লেবু, পেয়ারা, ডালিম, আনারস ও আম এই পাঁচটি দেশীয় ফল বেশি করে খাওয়া। রোগ-প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি, সি, এ, ই ও খনিজ উপাদান এ পাঁচটি ফলে প্রচুর পরিমান রয়েছে এবং এগুলো এ ঋতুতে পর্যাপ্ত পাওয়া যায়।
৮. পাতাযুক্ত সবুজ শাক-সবজি খাওয়া; তার মধ্যে পালংশাক, টমেটো, গাজর, মিষ্টিকুমড়া, কাচা মরিচ ও আদা খাদ্য তালিকায় বেশি রাখা।

রোগ-প্রতিরোধে ভেষজ উপাদান:
• হার্বাল টি: তুলসি, দারুচিনি, গোল-মরিচ, লবঙ্গ, কালোজিরা, আদাসহ চিনিমুক্ত গ্রিন টি তৈরি করে সকালে খাওয়া
• প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১০ গ্রাম পরিমাণ চ্যাবনপ্রাশ (বাজারে পাওয়া যায়) হালকা গরম পানি দিয়ে খাওয়া
• আমলকির রস ৫-১০ মি.লি. পরিমান খাওয়া
• বয়স্ক লোক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন ডি ও জিংক ট্যাবলেট গ্রহণ করতে পারেন।

যারা কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে আছেন তাদের জন্য পরামর্শ:
• হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলা
• উপরোল্লেখিত পরামর্শ মেনে চলা
• অল্প অল্প করে বার বার হালকা গরম পানি পান করা
• হার্বাল টি ও চ্যাবন প্রাশ গ্রহণ করা

জ্বর থাকলে:
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গুলঞ্চ লতা ভিজানো পানি ১৫ মি. লি. পরিমাণ দিনে ৩ বার+ কালোমেঘ চুর্ন ৩ গ্রাম পরিমান পানিসহ দিনে ৩ বার খেতে পারেন। 
অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক প্যারাসিটামল গ্রহণ করা যেতে পারে। অথবা অবস্থাভেদে উভয় একত্রেও গ্রহণ করা যেতে পারে।

শুকনো কাশি ও গলা ব্যথা থাকলে:
হালকা গরম পানি ও লবণ দিয়ে গড়গড়া করবেন দিনে ৩/৪ বার
পুদিনা, কালোজিরা ও দারুচিনির গরম বাস্প নাক দিয়ে টানবেন দিনে ২ বার
লবঙ্গ ও মধু অথবা আদা চুর্ণ ও গুড়সহ চুষে খাবেন
পিপুল, গোল-মরিচ, আদা, জিরা, বাসক পাতা একত্রে সমপরিমান নিয়ে ৪ গুন পানিসহ ঝাল দিয়ে ১ গুন অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে ঠাণ্ড করে দিনে ২/৩ বার খেতে পারেন।

করোনা ভাইরাস হয়েছে সন্দেহ হলে: দ্রুত টেস্ট করে শনাক্ত করুন এবং অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন। 

(বি: দ্র: ওপরের পরামর্শ কোভিড -১৯ এর চিকিৎসা নয়। এটি কেবল রোগ-প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করার কৌশল মাত্র, যা ঠাণ্ডা-কাশিসহ যে কোনো রোগের জন্যই উপকারী।) লেখক: প্রভাষক, সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিরপুর-১৩, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!