Home | উন্মুক্ত পাতা | যৌতুক-মোহরানা-বাল্য বিবাহ

যৌতুক-মোহরানা-বাল্য বিবাহ

470
আব্দুর রহিম : আমি যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে গিয়ে যেমন মোহরানার মোটা অংকের আতঙ্কের কথা শুনেছি ঠিক তেমনি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের কথাও শুনেছি।
শুনে কথা গুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই আমি শুনা কথা গুলো নিয়ে ভেবেছি। আজকে যৌতুক, মোহরানা ও বাল্যবিবাহ নিয়ে কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
যৌতুক বর্তমানে এমন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে যা মানুষের কাছে স্বভাবিক মনে হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে নিচ্ছে। যৌতুকের আশায় কর্মমুখীতা নষ্ট হচ্ছে যুবকের, যুবক হলেই তার মনের ভেতরে রাজা রাজা ভাব! কি সুঠামদেহ তেলাক্ত ত্বক চুলের বাহারি স্টাইল, গায়ে পরিস্কার সার্ট, পান্জাবী, লুঙ্গি, বা পেন্ট।
বাবার হোটেলে খাবার, ক্রিকেট খেলা তার দৈনন্দিনের উপভোগ্য খেলা মোটরসাইকেল দামী খাট-পালঙ্ক তার শক।
কিন্তু নিজে পরিশ্রম করে অর্জনে আগ্রহী নয়, বিয়ে করবে শশুরবাড়ি থেকে যৌতুক দেবে তিনি আয়েশ করবে। বিয়ের পরে বউ তার জন্য বোঝা! কর্ম নেই আছে স্মার্টনেস বিয়ের আগে কাজকর্ম করেনি বিয়ের পরে কাজ করলে বন্ধুরা কি বলবে!? লজ্জায় যেনো তার প্রাণ দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
বাবার হোটেলের খাবারদাবারও ধীরে ধীরে পানসে হয়ে যাচ্ছে… বাবাতো সারা জীবন ছেলেকে বেকার খাওয়াতে পারবেনা।
বাবা আগে চিন্তা করছিলো যতদিন ছেলে বিয়ে করেনি ততদিন হয়তো খাবে বিয়ের পর কর্ম করা শুরু করবে। বিয়েতেতো তেমন খরচ নেই খাট-পালঙ্ক ফ্রিজ মোটরসাইকেল বেয়াই উপহার দিবে সাথে নগদ টাকাও, তারা সেটা উপহার হিসাবেই দেখে! যাকে শতভাগ যৌতুক বলা যায়। যৌতুকের নগদ টাকা দিয়ে বিয়ের কড়চাপাতি সহ বিয়ের পর বেশ কয়েকদিন আনন্দের সাথে অতিবাহিত হয়।
ছেলে কর্ম করেনা বাবা বিরক্ত হয়, ছেলেকে কর্মের তাগদা দেয় বারংবার! কিন্তু ছেলে আগের মতোই। ছেলের বউকে দিয়েও বলানো হয় কর্ম করতে, কাজ হয়না। মোটরসাইকেলের পেক্টুলের দোকানে বাকি! চায়ের দোকানে বাকি, মুদির দোকানে বাকী, চারদিকে পাওনাদারেরা টাকা চায়। ছেলেটি কি করবে? তার ভেতরে কর্মমুখীতা তারপরও আসেনা, অলস মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে! চিন্তা আসে মোটরসাইকেল বিক্রি করবে! মোটরসাইকেল নিলামে তুলে সে, বিক্রি করে দেয়। মোটরসাইকেল ছাড়া বাড়ি ফিরতেই স্ত্রীর প্রশ্নের মুখোমুখী একটাই জবাব বিক্রি করে দিয়েছি…..! স্ত্রী বলে উঠে আমার বাবার দেয়া মোটরসাইকেল বিক্রি করেছো অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করলেনা। শুরু হয়ধন্ধ কলহ। আর একদিন ফ্রিজও বিক্রি করে দিলো।
এর পর বউকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এভাবেই চলতে থাকে…..
যৌতুক নিয়ে বিয়ে করা যাবে এই ভাবনা ছেলের তাই কর্মে মনযোগী হয়নি, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করানো যাবে সেই ভাবনায় বাবাও ছেলেকে কর্মমুখী করার জন্য প্রথম থেকে কঠোরভাবে চেষ্টা করেনি। যৌতুক মুক্ত বিয়ে করবো যৌতুক মুক্ত বিয়ে করাবো এই চিন্তা ও চেতনা লালন করলে কর্মমুখীতা আসতো ছেলের, পরিবার সচ্ছল হতো, আত্মসম্মান বাড়তো সমাজ ব্যাধি মুক্ত হতো।
যৌতুক দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেবার কারণঃ যৌতুক সামাজিক ব্যাধি সেটা জানা থাকার পরেও মেয়ের অভিভাবক যৌতুক দিয়ে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে হরহামেশাই! আপনি আমি কি একটি বারও ভেবেছি যে জানা থাকার পরও কেন একই ভুল বারবার করছে অভিভাবকগণ? না ভাবিনি ভাবলে এটা নিয়ে আমরা কথা বলতাম, রুখে দাড়ানোর চেষ্টা করতাম যারযার অবস্থান থেকে।
মেয়ের বাবা মায়ের চিন্তা চেতনায় মেয়ে বিয়ে দেবার টেনশন! কারণ মেয়ের বয়স মার্কের বাইরে গেলেই যৌতুকের অংকে আরো মোটা অংক যোগ করতে হবে। সেই মোটা অংকের ভাবনায় মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই ভারমুক্ত হবে। ভারমুক্ত হতে কে না চাই?ভারমুক্ত হতে বাধ্য হয়ে সরকারের বাল্যবিবাহ আইনের বাইরে যেতে হয় মেয়ের অভিভাবকগণকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি মেয়ের অভিভাবক আমি কোন দিক যাবো?
একদিকে যৌতুক নামের ভয়ানক ভাইরাস আমার ঘাড়ে! সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেড়ে বসেছে। অন্যদিকে আমাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃতিক বাল্য বাদ দিয়ে মানুষের খেয়াল খুশির নাবালকী!!
নারী বা পুরুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলমিন প্রকৃতিগত ভাবে বালক বালিকা হবার নিদর্শন দিয়েছেন। স্বাবলম্বী হবার পর একটি ছেলে প্রয়োজনে বালিকাকে বিয়ে করবে এটাই নিয়ম।
আল্লাহর দেয়া নিয়মাবলীর তোয়াক্কা না করে ১৪ বছর বয়সকে বাল্য মনে করে তাদের স্বইচ্ছায় অপকর্ম করতে বাঁধা নেই সরকারিভাবে। যত বাঁধা শুধু হালাল বিয়েতে!! বিয়ে করতে হলে মেয়েকে ১৮ হতে হবে এমন গান্জাখুরী সিদ্ধান্ত সমাজের অবক্ষয়ের কারণও বটে।
বাল্য বিবাহের বা ১৮ এর নিচে বিয়ের ব্যাপারে বাঁধা দেয়ার কারণ গুলো কি কি খোঁজ নিই..
১. পর্যাপ্ত পড়াশোনা করা।
২. স্বাবলম্বী হওয়া।
৩. স্বামীর পরিবার সামলে নেয়ার মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজনে।
পড়াশোনার ব্যপারে আমার দ্বিমত নেই মেয়েটি অবশ্যই পড়াশোনা করবে, যতটুকু সে চাই, পাশাপাশি নিজ পরিবারের ভারসাম্যের দিকে নজর দেয়াও জরুরি। মেয়েটি যদি বিশেষ মেধার অধিকারী হয় তা হলে মেয়ের জন্য মা বাবার উচিত আলাদা গুরুত্ব দেয়া, যেমনঃ মেয়েটি খুবই মেধাবী আরো দুই বছর পড়াশোনা করলে তার পক্ষে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা চলে আসবে যা আগামী প্রজন্মকে শিক্ষাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ডাঃ হবার যোগ্যতা রাখলে অর্থনৈতিক সমস্যা না থাকলে অভিভাবকদের দায়িত্ব মেয়েকে সময় দিয়ে সহযোগিতা কারা। কারণ একজন ডাক্তার হাজারো মানুষের জীবন বাঁচানোর উছিলা হয়ে থাকে।
প্রতিটি মানুষেরই স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে মেয়েরা বাদ যাবে কেন? স্বাবলম্বী হবার জন্য বিবাহ বাঁধা নয়, বর্তমান সময়ে স্বামীর পরিবারে মেয়েরা অর্থানৈতিক ভূমিকা রাখছে। সেলাই কাজ, কাপড়ে ফুলের ডিজাইন ইত্যাদি কাজ করে। ইচ্ছে করলে সেটা বাবার মায়ের পরিবারেও সম্ভব।
স্বামীর পরিবার সামলালো অত্যন্ত কঠিন কাজ, যে কাজটির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার চেয়ে বাস্তব অভিঙ্গতা অত্যন্ত কার্যকরী। মা তার মেয়েকে পরিবার সামলানো কেমন হয় তা ধারণা দিবে যেমন সাংসারিক কাজ, পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলার ধরন সহ বিভিন্ন বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই আইডিয়া দিতে দিতে বড় করবে। তখন সমস্যার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে আসে।
মোহরানা এখন আর ধর্মের আইন হিসাবে নিচ্ছেনা মানুষ, এখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য ফাঁদ হিসেবে বেচে নিয়েছে লোকজন। ধর্মীয় আইনে মোহরানা নগদ দেয়ার বিধান… সম্ভব হলে। বর্তমানে মোহরানা ফ্যাশন হিসেবে লোক দেখানোর জন্য ধার্য করা হচ্ছে। মোহরানা নির্ধারিত অংক নেই। যার যার তাওফীক অনুযায়ী ধার্য। অথচ বর্তমানে মোহরানার এক তৃতীয় অংশ টাকা ইচ্ছাকৃত ভাবে বাকি রাখা হয়।
বাকি রাখার উদ্দেশ্য হলো মোহরানার টাকার বাঁধ দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ টেকানো। এমন হাস্যকর উদ্দেশ্যের কারণে স্বামী স্ত্রীর মাঝে আন্তরিকতার বন্ধন তৈরি হয়না।
স্ত্রী চাই মোহরানার টাকার চাপ দিয়ে স্বামীকে নিজের ভাগে রাখবে! অথচ এটা সম্পূর্ণ রূপে অপ-কৌশল! ভালোবাসা আন্তরিকতা সহযোগিতা দিয়ে যদি স্বামীকে নিজের ভাগে রাখা না যায় বা ভালোবাসা আন্তরিকতা স্বামীকে ভাগে রাখার কৌশল না হয় সেখানে সুখের অস্তিত্ব থাকবে কি?
সুতরাং সংসারের সুখের জন্য মোহরানার টাকা বিনিয়োগ নয়, সংসারের সুখের জন্য মনটাকে বিনিয়োগ করুন একে অপরকে ভালোবাসুন। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সংসার সুদৃঢ় করার চেষ্টা করুন।
এর অর্থ এই নয় যে মোহরানা বাদ দিয়ে দিবেন। স্বামীর সাধ্য অনুযায়ী মোহরানা নির্ধারণ করুন, জোর করে আদায় করার কৌশল অবলম্বন করবেননা।
লেখকঃ আবুধাবি প্রবাসী। উদ্যোক্তা সদস্য,  পুটিবিলা যৌতুক ও মাদক বিরোধী সম্মিলিত সচেতন নাগরিক ঐক্য পরিষদ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!