Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | কর্ণফুলীতে ঢুকছে ‘বর্জ্যের পাহাড়’

কর্ণফুলীতে ঢুকছে ‘বর্জ্যের পাহাড়’

নিউজ ডেক্স : নগরে দৈনিক উৎপাদিত তিন হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) সংগ্রহ করে দুই হাজার টন। বাকি এক হাজার টন নালা-নর্দমা খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ে। কর্ণফুলী রক্ষায় প্রণীত দশ বছর মেয়াদী মাস্টার প্ল্যানের তথ্য অনুযায়ী, নগর ও আশেপাশের উপজেলাগুলোর ২৩টি খাল দিয়ে দৈনিক প্রায় ২২ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য পড়ছে কর্ণফুলীতে। এর মধ্যে যে সাতটি খাল দিয়ে বেশি বর্জ্য পড়ে তার পাঁচটির অবস্থান শহরে। প্রসঙ্গত, নগরের ৩৩টি খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ আছে কর্ণফুলী নদীর।

নগর থেকে যেসব বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ছে তার মধ্যে গৃহস্থলীর পাশাপাশি রয়েছে পলিথিনসহ অপচনশীল বর্জ্য। এসব বর্জ্যের কারণে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী। তাই কর্ণফুলী রক্ষায় সংযোগ খালের মুখে ‘গার্বেজ ট্রাপ’ বা ‘নেট’ দেয়ার জন্য চসিক ও সিডিএকে একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এমনকি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও পরামর্শ দিয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু এতে সাড়া দিচ্ছে না চসিক-সিডিএ। নেয়নি কোনো উদ্যোগও। চসিকের দায়িত্বশীলরা বলছেন, নগরের খালের উন্নয়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। তাই এ মুহূর্তে কিছু করার নেই চসিকের। আবার মেগা প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পে নেট বা গার্বেজ ট্রাপের বিষয়টি উল্লেখ নেই। তাই এ বিষয়ে আপাতত করার কিছু নাই।

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, খালগুলো নিয়ে প্রকল্প চলমান আছে। সেটা বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। চলমান প্রকল্পের মধ্যে নতুন করে আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি।

মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের প্রকল্পের মূল কাজ হচ্ছে খনন ও রিটেইনিং ওয়াল করা। সেখানে খালের মুখে নেট বা গার্বেজ ট্র্যাপ দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। তাই নেট দেয়ার সুযোগ নেই। গার্বেজ ট্র্যাপ দেয়ার জন্য আলাদা প্রকল্প নিতে হবে। সিটি কর্পোরেশন ২১টি খাল নিয়ে প্রকল্প নিচ্ছে। চাইলে সেখানে গার্বেজ ট্রাপ এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। তিনি বলেন, নেট বসালে অবশ্যই সুফল আসবে। কিন্তু নেটে যে ময়লা জমবে তা ম্যানুয়ালি পরিষ্কার করতে হবে।

কী আছে বন্দরের প্রস্তাবে : গত এপ্রিল মাসে চসিক ও সিডিএকে পত্র দিয়ে গার্বেজ ট্রাপ বসানোর প্রস্তাব দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গত মাসে তাগাদা দেয়। বন্দর সচিবের স্বাক্ষরিত চিঠিতে সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত এলাকায় সম্পাদিত ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের সুফল ধরে রাখা, নদীর যথাযথ নাব্যতা বজায় রাখা, কর্ণফুলী নদী দূষণরোধ এবং সর্বোপরি চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে প্রকল্প এলাকার অন্তবর্তী খালসমূহের মুখে জরুরি ভিত্তিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েক স্তরে আধুনিক প্রযুক্তির গার্বেজ ট্রাপ বা নেট স্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়।

বন্দরের দেয়া চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর পর্যন্ত বর্জ্য অপসারণ এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্পের ড্রেজিং কাজ শুরু হয়।। ২০২১ সালের ৯ জুলাই থেকে প্রকল্প এলাকার সদরঘাট অংশের ৪০০ মিটার জেটিতে ৪ মিটার ড্রাফটের লাইটার জাহাজের বাণিজ্যিক অপারেশন শুরু হয়েছে। সদরঘাট হতে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত প্রকল্প এলাকার নদীর যথাযথ প্রশস্ততা দৃশ্যমান হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় ৫০ দশমিক ৫০ লক্ষ ঘনমিটার মাটি বা বালি ড্রেজিং ও বর্জ্য অপসারণ করে চার মিটার গভীরতায় নাব্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরবর্তী সংরক্ষণ ড্রেজিং কার্য পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে সিটি মেয়র বরাবর দেয়া বন্দরের চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্প এলাকায় নগরের নয়-দশটি খাল কর্ণফুলী নদীতে যুক্ত আছে। খালগুলো দিয়ে প্রতিনিয়ত শহরে ব্যবহৃত ময়লা আবর্জনা (পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, গৃহস্থালি দ্রব্যাদি ও অন্যান্য অপচনশীল দ্রব্য) কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। খালগুলোর মুখে নির্দিষ্ট দূরত্বে কয়েক স্তরে আধুনিক প্রযুক্তির ডিসপজাল ব্যবস্থাসহ গার্বেজ ট্রাপ বা নেট স্থাপন করা হলে শহরের ময়লা-আবর্জনা সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়বে না। এতে নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা নিশ্চিতকরণসহ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

সংসদীয় কমিটির পরামর্শ : ২০২১ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশ পলিথিনমুক্ত রাখতে সংযুক্ত খালের মুখে নেট দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এমনকি এ বিষয়ে চসিক ও সিডিএ যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়।

এদিকে বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের পরামর্শক সংস্থা বিআরটিসি, বুয়েট প্রকল্পের ড্রেজিং কাজের সুফল ধরে রাখার জন্য প্রকল্প এলাকার অন্তবর্তী খালসমূহের মাধ্যমে ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে পতন রোধে খালগুলোর মুখে গার্বেজ ট্রাপ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

যেসব খাল দিয়ে বর্জ্য যায় কর্ণফুলীতে : কর্ণফুলী রক্ষায় প্রণীত দশ বছর মেয়াদী ‘মাস্টার প্ল্যান’ এর তথ্য অনুযায়ী, শহরের পাঁচটি খালের মুখ হচ্ছে কর্ণফুলী দূষণের হটস্পট। এর মধ্যে নগরের রুবি সিমেন্ট কারখানার পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালটি দিয়ে শিল্প বর্র্জ্য নদীতে মিশছে। মাইজপাড়া খাল দিয়ে বেশি যায় গৃহস্থলী বর্জ্য। মহেশখাল দিয়ে সবধরনের বর্জ্যই নদীতে পড়ে। নগরীর চাক্তাই খাল দিয়ে পয়:বর্জ্য ও গৃহস্থলী বর্জ্য কর্ণফুলীতে পড়ে।

এর বাইরে রাজাখালী খাল, ডোমখালী খাল, রাজাখালী ব্রাঞ্চ খাল-২, নোয়া খাল, গুপ্তা খাল, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, ১৫ নং ঘাট এয়ারপোর্ট খাল, কলাবাগিচা খাল, টেকপাড়া খাল, ফিরিঙ্গি বাজার খাল, মোগলটুলী খাল, সদরঘাট খাল-১ ও ২, নিজাম মার্কেট খাল, বির্জা খাল ও মরিয়ম বিবি খাল দিয়ে বিভিন্ন বর্জ্য কর্ণফুলীতে পতিত হয়।

খালগুলো দিয়ে নদীতে পতিত বর্জ্যগুলোর মধ্যে আছে গৃহস্থলী, রাসায়নিক সার ও শিল্পকারখানা বর্জ্য, মানববর্জ্য। এরমধ্যে পচনশীল বর্জগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে সমুদ্রে চলে যায়। কিন্তু অপচনশীল বর্জ্যগুলো নদীর তলদেশে আটকে থাকে। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে চিহ্নিত খালগুলোর মুখে কর্ণফুলী নদীর উপর-নিচ প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত বর্জ্যগুলো বিস্তৃত হয়।এদিকে কর্ণফুলী নদীর প্রাণ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণের কারণ নির্ণয়ে ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেইনিয়ন (ইকো) পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, নগরের বর্জ্য বিভিন্ন নালা অথবা ড্রেন দিয়ে সরাসরি কর্ণফুলীতে পড়ে নদী দূষণ করছে। দূষণ রোধ না হলে নদীর দুই পাড়ের ১৪৪ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে যাবে। এমনকি উদ্ভিদের পাশাপাশি ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্তির শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে দৈনন্দিন কাজে কর্ণফুলীর উপর নির্ভরশীল মানুষের চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে। -দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!